
আলীম মাহমুদ জুনিয়র
‘স্বাধীনতা তুমি /রবিঠাকুরের অঝর কবিতা, অবিনাশী গান
স্বাধীনতা তুমি/ কাজী নজরুলের বাবরী দোলানো
মহান পুরুষ, সৃষ্টি সুখের উল্লাসে কাঁপা-
স্বাধীনতা তুমি/ শহীদ মিনারে অমর একুশে ফেব্রুয়ারির উজ্জ্বল সভা
স্বাধীনতা তুমি…..’
বাংলা কবিতা সত্যিকার অর্থে পোশাকে আশাকে, মেজাজে ও মননে আধুনিক হয়ে উঠেছে হাতে গোনা ক’জন কবির অক্লান্ত সাধনায়, শামসুর রহমান তাঁদেরই একজন। আপাদমস্তক তিনি ছিলেন একজন কবি। কবিতায় আধুনিক জীবনবোধ ও চেতনা বাংলাদেশে তিরিশের দশকে শুরু হলেও ভাষার আধুনিকতা প্রায়োগিক রূপ পেতে শুরু করে মূলত চল্লিশের দশকে। আহসান হাবীব, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, সৈয়দ আলী আহসান ভাষা প্রয়োগের ক্ষেত্রে বেশ সচেতন হয়ে উঠেন এসময়। সাধু চলিত মিশ্রিত জীবনানন্দীয় কিংবা ফররুখীয় জগাখিচুড়ি ভাষাকে পাশ কাটিয়ে আধুনিক বাংলা ভাষাকে এরা কবিতায় স্বীকৃতি দেন। কিন্তু এ কথা অনীস্বীকার্য যে, বাঙালির আধুকি ভাষা বাংলা কবিতায় প্রকৃত প্রতিষ্ঠা পায় পঞ্চাশের কবিদের হাতে। এঁদের মধ্যে যিনি অগ্রগণ্য, তিনি শামসুর রহমান। তিনি আধুনিক কবি, আধুনিকতার কবি, একজন নাগরিক কবি।
শামসুর রহমানের অসংখ্য কবিতার মধ্যে একাট কবিতাও খুঁজে পাওয়া যাবেনা, যেখানে তাঁর কাব্যভাষা ফররুখীয় কিংবা জীবনানন্দীয় যুগের উদ্ভট ভাষার কাছে কখনও দ্বারস্থ হয়েছে। বাঙালি জাতির সৌভাগ্য যে, বাংলাদেশ জন্মাবার আগেই শক্তিশালী দু’জন কবি এর পক্ষে কলম ধরেছিলেন; এক. কবি শামসুর রহমান দুই. আল মাহমুদ। অনেকের কাছেই দেশের অস্তিত্বের জন্য রাজনীতিবিদদের ভূমিকাই মূখ্য বলে প্রতীয়মান হয়। দেশের জন্য কলম ধরা বলতে অনেকে বুঝে থাকেন রাজনীতি বিষয়ক কলামাদি লেখা কিংবা বড় জোর স্বদেশ বিষয়ক প্রবন্ধ রিবন্ধ লিখে দেশের হিত সাধন করা। ইতিহাস-উপন্যাস লিখেও যে দেশের পক্ষে সংগ্রাম করা যায় এটাও অনেকেই মানেন কিন্তু কবিতা লিখে যে দেশের চার পয়সার উপকার করা যায় সেটা বিশ্বাস করেন না-কোন রাজনীতিবিদ, না কোন প্রকাশক, না কোন পাঠক। তারপরও কবি ও কবিতা বারবার ফিরে আসে আমাদের জীবনে। আমাদের প্রাত্যহিক মনোকেন্দ্রিক জগতে তো বটেই, জাতীয় জীবনেও। শামসুর রহমানের ‘স্বাধীনতা তুমি’ তুমি আসবে বলে হে স্বাধীনতা’ ‘বুক তার বাংলাদেশের হৃদয়’ প্রভৃতি কবিতা এ প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
কবি শামসুর রহমানের সমগ্র কাব্যজীবনের মূল সুর মূলত; দেশপ্রেম। দেশকে নিয়ে এতো বেশি কবিতা আধুকিকালে জীবনানন্দ দাশের পরে আর কেউ লিখেছে কিনা জানা নেই। আধুনিক কবিতা বলতে বাংলাদেশের মানুষ বুঝে নিরেট গদ্য কবিতা, ধারণাটা যে ভ্রান্ত, তা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা। তারপরও এত বৈরী আবহাওয়ায় গদ্য কবিতা লিখে, তাও আবার দেশের কবিতা, কবিতাকে যে জনপ্রিয় করে তোলা যায়. তার জ্বলন্ত প্রমাণ শামসুর রহমান। রবীন্দ্র, নজরুল, জীবনানন্দের পর তাঁর মতো বেশি জনপ্রিয় হতে আর কাউকে দেখা যায়নি। তাঁর জনপ্রিয়তার মূলে রয়েছে কবিতায় সরলতা আর স্বদেশের সুর। শামসুর রহমান শুধু বাংলাদেশের প্রধান কবিই নন, তিনি স্বাধীনতার কবি, নাগরিক কবি, মুক্তিযুদ্ধের কবি এমনই আরও নানাভূষণে অভিহিত করা যায়। বহুমাত্রিক লেখক হুমাযূন আজাদ কবি শামসুর রহমানকে আখ্যা দেন ‘নি:সঙ্গ শেরপা’ বলে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালেই শামসুর রাহমানের কবি খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। আধুনিক কবিতার সঙ্গে তার পরিচয় ও আন্তর্জাতিক-আধুনিক চেতনার উন্মেষ ঘটে ১৯৪৯ সালে। এ সময় তার প্রথম কবিতা মুদ্রিত হয় সাপ্তাহিক ‘সোনার বাংলা’ পত্রিকায়। প্রথম কাব্য গ্রন্থ ‘প্রথম গান, দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে’ প্রকাশিত হয় ১৯৬০ সালে। তার লেখা ‘বর্ণমালা, আমার দুখিনী বর্ণমালা’, ‘আসাদের শার্ট’, ‘স্বাধীনতা তুমি’, ‘তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা’, এসব কবিতার মধ্যে তার বিদ্রোহী চেতনার বহিঃপ্রকাশ ঘটে।
কবি শামসুর রাহমান পেশায় সাংবাদিক ছিলেন। সাংবাদিক হিসেবে ১৯৫৭ সালে কর্মজীবন শুরু করেন দৈনিক মর্ণিং নিউজ-এ। ১৯৫৭ সাল থেকে ১৯৫৯ সাল পর্যন্ত রেডিও পাকিস্তানের অনুষ্ঠান প্রযোজক ছিলেন। এরপর তিনি আবার ফিরে আসেন তার পুরানো কর্মস্থল দৈনিক মর্ণিং নিউজ-এ। তিনি সেখানে ১৯৬০ সাল থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত সহযোগী সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৬৪ থেকে শুরু করে ১৯৭৭ এর জানুয়ারি পর্যন্ত‘দৈনিক পাকিস্তান’ এর সহকারী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন (স্বাধীনতা উত্তর দৈনিক বাংলা)। ১৯৭৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি দৈনিক বাংলা ও সাপ্তাহিক বিচিত্রা’র সম্পাদক নিযুক্ত হন। ১৯৮৭ তে সামরিক সরকারের শাসনামলে তাকে পদত্যাগ বাধ্য করা হয়। পরে তিনি ‘অধুনা’ নামে মাসিক সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন।
জন্ম ১৯২৯ সালের ২৩ অক্টোবর ঢাকার মাহুতটুলিতে নানাবাড়িতে। পৈতৃক বাড়ি নরসিংদী জেলার রায়পুরায় পাড়াতলী গ্রামে। বাবা মুখলেসুর রহমান চৌধুরী ও মা আমেনা বেগম। ১৩ ভাই বোনের মধ্যে শামসুর রাহমান চতুর্থ। কবির জীবনের পুরোটা সময় কেটেছে ঢাকা শহরে। শৈশব, বেড়ে ওঠা, পড়াশোনা এ ঢাকাতেই।
আমৃত্যু অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও জনমানুষের প্রতি অপরিসীম দরদ ছিল তার চেতনায় প্রবাহমান। শামসুর রাহমানের বিরুদ্ধে বারবার বিতর্ক তুলেছে কূপমন্ডুক মৌলবাদীরা। তাকে হত্যার জন্য বাসায় হামলা করেছে। এতকিছুর পরও কবি তার বিশ্বাসের জায়াগায় ছিলেন অনড়। ২০০৬ সালের ১৭ আগস্ট বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। শেষ ইচ্ছানুযায়ী ঢাকাস্থ বনানী কবরস্থানে মায়ের কবরে তাকে সমাধিস্থ করা হয়।
প্রকাশিত কাব্য : প্রথম গান, দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে (১৯৬০), রৌদ্র করোটিতে (১৯৬৩), বিধ্বস্ত নিলীমা (১৯৬৭), নিরালোকে দিব্যরথ (১৯৬৮), নিজ বাসভূমে (১৯৭০), বন্দী শিবির থেকে (১৯৭২), দুঃসময়ে মুখোমুখি (১৯৭৩), ফিরিয়ে নাও ঘাতক কাটা (১৯৭৪), আদিগন্তনগ্ন পদধ্বনি (১৯৭৪), এক ধরনের অহংকার (১৯৭৫), আমি অনাহারী (১৯৭৬), শূন্যতায় তুমি শোকসভা (১৯৭৭), বাংলাদেশ স্বপ্ন দেখে (১৯৭৭), প্রতিদিন ঘরহীন ঘরে (১৯৭৮), ইকারুসের আকাশ (১৯৮২), মাতাল ঋত্বিক (১৯৮২), উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে (১৯৮৩), কবিতার সঙ্গে গেরস্থালি (১৯৮৩), নায়কের ছায়া (১৯৮৩), আমার কোন তাড়া নেই (১৯৮৪), যে অন্ধ সুন্দরী কাঁদে (১৯৮৪), অস্ত্রে আমার বিশ্বাস নেই (১৯৮৫), হোমারের স্বপ্নময় হাত (১৯৮৫), শিরোনাম মনে পড়ে না (১৯৮৫), ইচ্ছে হয় একটু দাঁড়াই (১৯৮৫), ধুলায় গড়ায় শিরস্ত্রাণ (১৯৮৫), এক ফোঁটা কেমন অনল (১৯৮৬), টেবিলে আপেলগুলো হেসে উঠে (১৯৮৬), দেশদ্রোহী হতে ইচ্ছে করে (১৯৮৬), অবিরল জলভ্রমি (১৯৮৬), আমরা কদজন সঙ্গী (১৯৮৬), ঝর্ণা আমার আঙুলে (১৯৮৭), স্বপ্নেরা ডুকরে উঠে বারবার (১৯৮৭), খুব বেশি ভালো থাকতে নেই (১৯৮৭), মঞ্চের মাঝখানে (১৯৮৮), বুক তার বাংলাদেশের হৃদয় (১৯৮৮), হৃদয়ে আমার পৃথিবীর আলো (১৯৮৯), সে এক পরবাসে (১৯৯০), গৃহযুদ্ধের আগে (১৯৯০), খন্ডিত গৌরব (১৯৯২), ধ্বংসের কিনারে বসে (১৯৯২), হরিণের হাড় (১৯৯৩), আকাশ আসবে নেমে (১৯৯৪), উজাড় বাগানে (১৯৯৫), এসো কোকিল এসো স্বর্ণচাঁপা (১৯৯৫), মানব হৃদয়ে নৈবদ্য সাজাই (১৯৯৬), তুমিই নিঃশ্বাস তুমিই হৃৎস্পন্দন (১৯৯৬), তোমাকেই ডেকে ডেকে রক্তচক্ষু কোকিল হয়েছি (১৯৯৭), হেমন্ত সন্ধ্যায় কিছুকাল (১৯৯৭), ছায়াগণের সঙ্গে কিছুক্ষণ (১৯৯৭), মেঘলোকে মনোজ নিবাস (১৯৯৮), সৌন্দর্য আমার ঘরে (১৯৯৮), রূপের প্রবালে দগ্ধ সন্ধ্যা রাতে (১৯৯৮), টুকরা কিছু সংলাপের সাঁকো (১৯৯৮), স্বপ্নে ও দুঃস্বপ্নে বেঁচে আছি (১৯৯৯), নক্ষত্র বাজাতে বাজাতে (২০০০), শুনি হৃদয়ের ধ্বনি (২০০০), হৃদপদ্মে জ্যোৎস্না দোলে (২০০১), ভগ্নস্তুপে গোলাপের হাসি (২০০২), ভাঙাচোরা চাঁদ মুখ কালো করে ধুকছে (২০০৩), গন্তব্য নাই বা থাকুক (২০০৪), কৃষ্ণপক্ষে পূর্ণিমার দিকে (২০০৪), গোরস্থানে কোকিলের করুণ আহবান (২০০৫), অন্ধকার থেকে আলোয় (২০০৬) এবং না বাস্তব না দুঃস্বপ্ন (২০০৬)। শিশু সাহিত্য : এলাটিং বেলাটিং (১৯৭৪), ধান ভানলে কুঁরো দেব (১৯৭৭), গোলাপ ফোঁটে খুকীর হাতে (১৯৭৭), স্মৃতির শহর (১৯৭৯), রংধনুর সাঁকো (১৯৯৪), লাল ফুলকির ছড়া (১৯৯৫), নয়নার জন্য (১৯৯৭), আমের কুঁড়ি জামের কুঁড়ি (২০০৪) এবং নয়নার জন্য গোলাপ (২০০৫)।
উপন্যাস : অক্টোপাশ (১৯৮৩), অদ্ভুত আঁধার এক (১৯৮৫), নিয়ত মন্তাজ (১৯৮৫) এবং এলো সে অবেলায় (১৯৯৪)।
কবি শামসুর রাহমান আধুনিক কবিতার পথিকৃত। গদ্য কবিতার পথিকৃত, জনক। আজকাল আধুনিক যে সকল কবি দেখা যায় কবি শাসুর রাহমানের হাত ধরে গদ্য কবিতার জন্ম না হলে হয়তো এই কবিদের জন্মই হতো না। তাই বলে তিনি যে ছন্দের কবি ছিলেন না তা কিন্তু নয়। বাংলা ভাষায় রবীন্দ্রনাথের পর সবচেয়ে বেশি ছন্দের ব্যবহার এবং ভাষা চয়নের বেলায় সবচেয়ে বেশি সচেতন ছিলেন এই কবি। ২০০৬ সালের ১৭ আগস্ট এই মহান কবি চলে যান না ফেরার দেশে। ২০১৬ সালের ১৭ আগস্টে এই মহান কবির প্রয়াণ দিবসে তাঁর বিদেহী আত্মার প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি।
[সহায়ক : উইকিপিডিয়া। শামসুর রহমান গ্রন্থাবলী। বিসিএস লেকচার শীট। ইন্টারনেট]
লেখক : প্রভাষক (রাষ্ট্রবিজ্ঞান), সরকারি মুজিব কলেজ। সখীপুর।