“ সত্য যে কঠিন কঠিনেরে ভালোবাসিলাম ” কবি গুরু রবীন্দ্রনাথের লেখা দিয়ে শুরু করলাম। কঠিন বলতে তিনি সত্যকে বুঝিয়েছেন পারেন ? ভালো লাগা আর ভালোবাসা অনেক পরের কথা। তবে মেনে না নিলেও মানিয়ে নিতে পারি সবাই। যেমন টি মোসলেম আবু শফী স্যারের মৃত্যু। ১০ মার্চ দুই বছর অতিক্রম হলো। আমরা সখীপুরের সাংবাদিকরা তাঁর মৃত্যুকে মানিয়ে নিয়েছি। কিন্তু মেনে নেই নি কেউ। এখনো আমরা প্রয়োজন অনুভব করি তাঁর। মোসলেম আবু শফী স্যার নেই কিন্তু এখানে ওখানে পড়ে আছে তাঁর স্মৃতি। দেয়ালে ফ্রেমে বাধাঁ তাঁর হাস্যজ্জ্বল ছবি। ছবির দিকে তাকালে মনে হয় তাঁর ছবি অনেক কথা বলছে। অনেক প্রশ্ন করছে। জবাব দিতে গিয়ে অনুভব করি তাঁর অনুপস্থিতি। মাঝে মধ্যে নিজেকে অনেক দূর্ভাগা মনে হয়। যে দিন সন্ধ্যায় তিনি মোটর সাইকেল দূর্ঘটনায় আহত হোন সে দিন সকালে আমাকে ফোন করে বলে ছিলো “ সজল কোথায় ? তোমার সাথে কিছু কথা আছে।” আমি বললাম- স্যার আমিতো বাড়িতে, সন্ধ্যায় দেখা করবো স্যার। সঙ্গে সঙ্গে মোবাইল রেখে দিলেন। ঠিক সেই দিন সন্ধ্যায় দেখা হলো হাসপাতালের ভেতরে। মূমুর্ষ অবস্থায় ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হলো তাঁেক। মৃত্যুর সাথে লড়াই করে যে দিন শেষ নিঃস্বাস ত্যাগ করলেন সে দিন ছিলো মার্চের ১০ তারিখ। ১০ মার্চ যখন কফিনে চড়ে মোসলেম আবু শফী স্যার ঢাকা থেকে সখীপুর আসলেন সেদিন আমি ঢাকায়। ঢাকা ছাত্রাবাসে বসে সংবাদটি শুনতে পেলাম। কিন্তু ১১ তারিখ আমার মার্স্টাসের নির্বাচনী পরীক্ষা। যে কারনে স্যারের জানাজা নামাজ পড়তে পারি নাই। শোক আফসোসের মধ্যেই কেটে গেলো সেই মূহুর্ত। তার পর সখীপুর প্রেসক্লাবের আয়োজনে ২৩ এপ্রিল উপজেলা হলরুমে অনুষ্ঠিত হলো স্মরণ সভা। কষ্টের বিষয় সেদিনও শোক স্মরণে কিছু বলার জন্য আসতে পারি নাই। কারন সেদিন ছিলো আমাদের বাড়িতে আমার বউ ভাত। যে কারনে আমি নিজেকে দূর্ভাগা বলে আক্ষায়িত করলাম। মোসলেম আবু শফী স্যার আমার ক্লাসের স্যার না কলেজের স্যার ছিলেন। তাঁর কাছ থেকে আমি কোন খবর লিখতে শিখিনি। তবে সাংবাদিক হওয়ার অনুপ্রেরণা পেয়েছি। উৎসাহ পেয়েছি। তাকে অনুকরণ করেছি। অনুসরণ করেছি আমি এবং আমরা যারা সাংবাদিক।
সখীপুরে সংবাদ পত্র ও সাংবাদিকতার একটি ইতিহাস লিখলে চলে আসে মোসলেম আবু শফী স্যারের কথা। তিনি শুধুই সাংবাদিক ছিলেন না সাংবাদিক তৈরির কারিগর ছিলেন। সখীপুর প্রেসক্লাবের সূচনা লগ্ন থেকে আমৃত্যু পর্যন্ত সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। আমরা তাঁর কথার সুরের সাথে সুর মিলাতাম। সখীপুর প্রেসক্লাব তথা প্রেসক্লাবের সাংবাদিকরা ছিলো তাঁর পরিবারের মতো। হাস্য উজ্জ্বল মুখ খানা তাঁর কখনো কখনো আবেগে রাগান্বিত হতো। তিনি ভালোবাসতেন বঙ্গবন্ধুকে। রাজনীতি করতেন আওয়ামী লীগের। সখীপুর উপজেলা ছাত্র লীগের সভাপতি ছিলেন। উপজেলা যুব লীগেরও সভাপতি ছিলেন। অত:পর রাজনীতি থেকে বের হয়ে এলেন সাংবাদিকতায়। সাংবাদিক হিসেবে দৈনিক জাহান, দৈনিক সংবাদ ও দৈনিক যুগান্তর পত্রিকায় কাজ করেছেন তিনি। সরকারি মুজিব কলেজের অর্থনীতি বিভাগের সহকারি অধ্যাপক ছিলেন। সংস্কৃতি প্রিয় এই মানুষটি তাঁর এলাকার গরীব অসহায় মানুষের পাশে দাড়াতেন। চিকিৎসা সেবা, অর্থনৈতিক সহযোগিতা, নানাবিধ পরামর্শসহ বিভিন্ন ভাবে আর্তমানবতার সেভায় কাজ করতেন মোসলেম আবু শফী স্যার। মাঝে মধ্যেই সখীপুর প্রেসক্লাবে বসে প্রেসক্লাব সম্পর্কে স্যার বলতেন “ বুঝবা, আমি যেদিন থাকবোনা সে দিন বুঝবা।” সত্যিই স্যার দারুন এক সময় অতিবাহিত করছি আমরা। মনে হয় এইতো সেদিন স্যারকে নিয়ে মধুপুর গিয়ে ছিলাম প্রেসক্লাবের আনন্দ ভ্রমনে। মাইক্রো বাসের ভিতরে কত গান, কৌতুক, গল্প, ছবি তোলা, হাসা হাসি আর মাতা মাতি। যা কোন দিন ভুলার নয়। ভাবতেও পারিনা মোসলেম আবু শফী স্যার নেই। তিনি আর আসবেন না আমাদের মাঝে। এটাই বাস্তব। এটাই চির সত্য। এই সত্য বড় কঠিন। লেখার শুরুতে এই সত্যর কথা বলেছিলাম। মোসলেম আবু শফী স্যারের সন্তান, স্ত্রী, তাঁর বৃদ্ধ মা, বড় ভাই যাঁরাই আছেন তাঁরা কি এই সত্যকে মেনে নিতে পেরেছেন ? তবে মানিয়ে নিয়েছেন সবাই। নিষ্ঠুর এ পৃথিবীর প্রকৃতি। এই প্রকৃতি কোন শূন্য স্থান রাখতে পছন্দ করেনা। আর মানুষও প্রকৃতি থেকে শিক্ষা নিয়ে অনেক দুর এসেছে। আর একটি কবিতা দিয়ে লেখাটি শেষ করবো। জীবনানন্দ দাশের কবিতা
“চলে যাব- তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ
প্রাণপণে পৃথিবীর সবার জঞ্জাল,
এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য ক’রে যাব আমি-
নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।”
আমরা যে যেখানেই থাকিনা কেন আর যে কাজই করিনা কেন তা যেন দায়িত্ববোধ থেকেই করি। এই পৃথিবীতে আমাদের অনেক দায়িত্ব আছে। স্ব স্ব অবস্থানে দাড়িয়ে কাজ করার সময়ই সে দায়িত্ব পালন করা যায়। আসুন আরো একটু এগিয়ে আসি মানব সেবায় ও সুন্দর প্রকৃতি বিনির্মানে । ভালোবাসা পেতে বিলিয়ে যাই প্রেম।

লেখক : সাংবাদিক ও সংস্কৃতিকর্মী।