বিস্তীর্ণ জনপদের বিচিত্র জনগোষ্ঠীর সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা নিয়ে রচিত এক বর্ণাঢ্য সাহিত্য সৃষ্টির ইতিহাস। বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন চর্যাপদের সূচনা থেকে বর্তমান কাল পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসকে প্রাচীন, মধ্য ও আধুনিক- এই তিন যুগে ভাগ করা হয়েছে। আর মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে দেব-দেবীর লীলা- মাহাত্ম্য বর্ণনা করে এক শ্রেণীর কাব্য রচনা করা হতো। এ শ্রেণীর কাব্য “মঙ্গলকাব্য” নামে অভিহিত। কারণ, কারো কারো ধারণা ছিল- এ কাব্যের কাহিনী শ্রবণ করলে সকল অকল্যাণ নাশ হয় এবং পূর্ণাঙ্গ মঙ্গল লাভ হয়। মঙ্গলকাব্যের এ ধারায় চন্ডীমঙ্গলের একটি বিশেষ স্থান রয়েছে।

- চন্ডীদেবীর কাহিনী অবলম্বনে রচিত চন্ডীমঙ্গল কাব্য এ দেশে যথেষ্ট জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলো। চন্ডীদেবীর উৎপত্তি নিয়ে নানামত প্রচলিত। সম্ভবত: বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে স্বতন্ত্র প্রকৃতির যে সব স্ত্রী-দেবতার পরিকল্পনা করা হয়েছিলো তা কালক্রমে চন্ডী নামে পরিচিত লাভ করেছে। চন্ডী আদিতে অনার্য মূলোদ্ভূত ছিলেন, পরে বৌদ্ধ ও হিন্দুতান্ত্রিক দেব পরিকল্পনার সঙ্গে মিশে ক্রমে পৌরাণিক পার্বতীর সঙ্গে সম-ঐতিহ্য সূত্রে বিধৃত হয়েছেন। এ চন্ডীদেবীর কাহিনী অবলম্বনেই “চন্ডীমঙ্গল” কাব্যের ধারা রূপায়িত হয়েছে। তবে অপরাপর মঙ্গলকাব্যে যেখানে একটি কাহিনী বর্তমান, চন্ডীমঙ্গল এর ব্যতিক্রম, এতে আছে দু’টি কাহিনী। চন্ডীমঙ্গলে সমকালীন সমাজ-জীবনের সাধারণ, বর্ণহীন ও তুচ্ছাতিতুচ্ছ ঘটনায় সম্প্রসারিত মানবজীবন বর্ণিত হয়েছে। বাঙালির সুখ-দুঃখ, সামাজিক দলাদলি, কুসংস্কার, বারমাসী রন্ধনপ্রণালী, বেশভূষা, বিবাহ-বিধি, পরনিন্দা প্রভৃতি বিষয়ও চন্ডী মঙ্গলে উপভোগ্য হয়েছে। এ কাব্যের গল্প বাস্তবতার অনুসারী, স্বাভাবিকতা ও মানবিকতায় সমৃদ্ধ। চন্ডীদেবী মনসার মত উগ্র মেজাজের ছিলেন না, তার মধ্যে মানবপ্রীতির পরিচয় স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠেছে।
মঙ্গলকাব্যের সাধারণ বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী এবং অন্যান্য মঙ্গলকাব্যের ন্যায় চন্ডীমঙ্গলে শুধু লৌকিক জীবন বর্ণনার মধ্যেই স্থান পায়নি, দেব-দেবীর জীবনের মধ্যেও সমভাবে বর্তমান। তাই লৌকিক জীবনের পটভূমিতে আছে যে অলৌকিক পরিবেশ পার্থিব মানুষের পেছনে আছে যে অপার্থিব দেব-দেবীর রাজত্ব তাও সুনিশ্চিতভাবে মানবিক রসে, ভাবনা-চিন্তায়, ভোগ-তৃপ্তিতে সিঞ্চিত।
চন্ডীমঙ্গল কাব্যের কাহিনী: চন্ডীমঙ্গল কাব্যের কাহিনী দুই খন্ডে বিভক্ত। চন্ডী মঙ্গলের মূল-কাহিনী লোকায়িত, সেই সঙ্গে একটি নাগরিক কাহিনীও সংযোজিত। একটি আিেটক খন্ড এবং অপরটি বণিক খন্ড। প্রথম খন্ডে আিেটক বা ব্যাধ কালকেতুর কাহিনী এবং দ্বিতীয়টিতে বণিক ধনপতির কাহিনী বর্ণিত হয়েছে। নিচে কাহিনী দু’টির সংপ্তি বিবরণ পেশ করতে স্বচেষ্ট হবো-
(ক) কালকেতু: পর্বত-রাজপুত্রী দেবী আসলে অরণ্যানী। তিনি অরণ্য ভূমিপূর্ণ কলিঙ্গ জনপদের অধিপতিকে স্বপ্নে নির্দেশ দিলেন। সেই অনুসারে রাজা কংসনদের তীরে অরণ্য ভূমির প্রান্তে তমাল তরুতলে দেবীর বিচিত্র দেউল নির্মাণ করে তাতে একক দেবী মূর্তি প্রতিষ্ঠা করলেন। ভালো রকম পূজার ব্যব¯’াও হলো। দেবী স্বশরীরে এসে পূজা নিলেন। পূজা পেয়ে খুশি হয়ে দেবী স্বস্থানে প্রস্থান করছেন এমন সময় অরণ্য প্রাণীরা তাকে দেখে নিজেদের দেবতা জেনে সাধ্যমত পূজা দিলো। দেবী অভয়া তাদের সকলকে ভরসা দিলো এবং সিংহকে রাজা করে অন্য পশুদের তার অধীনে যথাযোগ্য নিয়োগ ব্যবস্থা করে কৈলাসে চলে গেলেন ?
পূজা পাওয়া গেলো কিন্তু অরণ্য রাজার ও পশুর পূজা দেবীর মনে প্রশান্তি আসলো না। জনবিরল সমাজে দেব-মাহাত্ম্য যেন গুপ্ত রয়ে গেলো। সখী পদ্মাবতী তখন আবার পরামর্শ দিলেন। শিবভক্ত ইন্দ্রের পুত্র অরণ্যরসিক নীলাম্বরকে দেবী শিবের শাপ দেওয়াইয়া জগতে মনুষ্যজন্ম নিতে বাধ্য করলেন। সে তার মাহাত্ম প্রচারে হেতু হবে। কলিঙ্গ জনপদে ব্যাধের ঘরে নীলাম্বর জন্ম নিলেন, নাম হলো- কালকেতু। যথাসময়ে তার বিয়ে হলো, স্ত্রীর নাম- ফল্লরা। স্বামী- স্ত্রীর সংসার। কালকেতু বনে বনে ঘুরে পশু শিকার করে আর ফুল্লরা হাটে পসার দিয়ে অথবা লোকের বাড়ী বাড়ী ঘুরে মাংস বেচে। নিরুপদ্রব শান্তিময় জীবন, অবশ্য দারিদ্রের চেতনায় ম্লান। কালকেতুর এহেন অত্যাচারে এ দিকে বনে পশু-পাখীর জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠায় এরা চন্ডীদেবীর শরনাপন্ন হলো, দেবী তাদের অভয় দিলেন। দেবী কালকেতুকে ছলনা করলেন, শিকার মেলে না। কিন্তু একদিন দেবী স্বর্ণ-গোধিকা হয়ে কালকেতুর হাতে ধরা দিলেন। কালকেতুর অনুপস্থিতিতে দেবী ফুল্লরার নিকট একটি লাবন্যময়ী নারী মূর্তিতে প্রকাশিত হন। ফুল্লরা তাকে স্বগৃহে ফিরে যাওয়ার জন্য অনুরোধ- উপরোধ করে, কিন্তু তিনি অবিচল। পরে কালকেতু এসেও তাকে পীড়াপীড়ি করল, কিন্তু কোন ভাবেই তাকে বিচলিত করতে না পেরে কালকেতু ধনুকে শর জোড়ে। তখন দেবী আত্মপ্রকাশ করেন এবং কালকেতুকে সাত ঘড়াধন ও একটি অঙ্গুরি দিয়ে প্র¯’ান করেন। দেবীর আদেশে কালকেতু গুজরাট বন কাটিয়ে নগর ¯’াপন করল, নতুন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করল। নগর ধনে-জনে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠলে ভাঁড়-দত্ত নামে এক ধূর্তলোক কালকেতুর আশ্রয়ে থেকে প্রজাদের ওপর নানা প্রকার অত্যাচার করতে থাকে। কালকেতু তা জানতে পেরে ভাঁড়-দত্তকে তাড়িয়ে দিল। কিন্তু ভাঁড়-দত্তের চক্রান্তে প্রতিবেশী কলিঙ্গরাজের সঙ্গে কালকেতুর যুদ্ধ দেখা দিলো। কালকেতু যুদ্ধে পরাস্ত হয়ে বন্দী হলো। চন্ডীদেবীর আক্রোশে ইতিপূর্বেই কলিঙ্গরাজের দেশ ভেসে গিয়েছিলো, এবার দেবী কলিঙ্গরাজকে স্বপ্নে দেখা দিয়ে কালকেতুকে মুক্তি দেবার জন্য এবং তার রাজত্বকে স্বীকৃতি জানাতে আদেশ দিলেন। মুক্তির পর দীর্ঘকাল রাজত্ব করে পুত্র পুষ্পকেতু হাতে মতা হস্তান্তরপূর্বক কালকেতু স্ত্রী ফুল্লরাসহ শাপান্তে স্বর্গে ফিরে গেলেন। উল্লেখ্য, কালকেতু রূপী স্বর্গের নীলাম্বর, পত্মী ছিল- ফুল্লরারূপী ছায়া।
(খ) বণিক ধনপতি: চন্ডী দেবীর পূজা প্রচার হয়েছে কিন্তু তা প্রত্যন্ত ও সংকীর্ণ অঞ্চলে, কলিঙ্গ জনপদে ও দরিদ্র সমাজে। এমন পূজায় দেবী সম্পূর্ণ খুশি হতে পারলেন না। তখন পদ্মাবতী পরামর্শ দিলেন দেশের উন্নত শহর উজানিতে ধনী বণিক এবং পরম শিবভক্ত ধনপতিকে অবলম্বন করে নতুন পূজা খেলা দেখাতে। ধনপতির কাছে পূজা আদায় করতে পারলে নাম-যশ তো খুবই হবে, উপরন্ত শিবকেও কিছু শিক্ষা দেয়া যাবে? দেবী সখীর পরামর্শ গ্রহণ করলেন। আগের বার তার শুধু এক ব্রতদাস ছিল- ইন্দ্রপুত্র নীলাম্বর, এবারে তার ব্রতদাস ও ব্রতদাসী দুই-ই হলো। ব্রতদাসী হলো- ইন্দ্রসভার নর্তকী রতœমালা, আর ব্রতদাস হলো- দেবনট মালাধর, কাহিনীতে যথাক্রমে ধনপতির দ্বিতীয় পতœী ও তার গর্ভজাত পুত্র। ধনপতি বিবাহিত পুরুষ, পতœী লহনা উজানির অনতিদূরবর্তী ইছানী নগরের অধিবাসী বণিকের কন্যা। একদিন পায়রা উড়াতে উড়াতে ধনপতি ইছানীতে গিয়ে পড়ল এবং পতœী লহনার খুল্লতাত ভগ্নি খুল্লনাকে দেখলো? সে খুল্লনার প্রতি প্রেমাসক্ত হয়ে তাকে বিয়ে করলো। বিয়ের পর খুল্লনাকে লহনার কাছে রেখে ধনপতি রাজাজ্ঞায় সুবর্ণপিঞ্জর আনার জন্য গৌড়ে গেল। সতীনের প্রতি ঈর্ষাকাতর হয়ে লহনা খুল্লনাকে নানা প্রকার অত্যাচার করতে লাগলো। বাধ্য হয়ে খুল্লনা বনে গেলো ছাগল চরাতে। সেখানে খুল্লনা চন্ডীদেবীর পূজাপদ্ধতি শিখে নিয়ে চন্ডীর পূজা সম্পন্ন করে। এতে চন্ডীদেবী তার প্রতি প্রসন্ন হন। চন্ডীর স্বপ্নাদেশ পেয়ে ধনপতি সওদাগর ফিরে আসে। খুল্লনার চন্ডীর পূজা দেখে ধনপতি রেগে পূজার ঘট পায়ে ঠেলে ফেলে দিলো। ধনপতির প্রথমা স্ত্রী লহনা এ বিয়ের কথা শুনে অভিমান করেছিলো। ধনপতি তাকে অনেক বুঝালো সবিশেষে লহনা একখানা পাটশাড়ি ও চুরি তৈরীর জন্য পাঁচতোলা সোনা পেয়ে বিয়েতে সম্মতি দিলো।
খুল্লনা বনে ছাগল চরাতো বলে স্বজাতিবর্গ তার সতীত্ব সম্বন্ধে সন্দেহ প্রকাশ করলো। খুল্লনা সতীত্বের পরীা দিলো। তাকে জলে ডুবানোর চেষ্টা
করা হলো, সাপ দিয়ে কামড়ানো হলো, প্রজ্বলিত লৌহদন্ডে বিদ্ধ করা হলো, শেষে তাকে জতুগৃহে রেখে আগুন দেয়া হলো কিন্তু খুল্লনার কিছুই হলো না। সে সতী হিসেবে বিবেচিত হলো। কিছুদিন পর বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে ধনপতি সিংহল যাত্রা করে। পথে কালিদহে কমলে কামিনী মূর্তি দেখতে পায়। সেখানে এক অপরূপ সুন্দরী তরুণী পদ্মের ওপর বসে এক বিরাট হাতী গলধঃকরণ ও উদ্গীরণ করছে। এই অপূর্ব ও আশ্চর্য দৃশ্যের কথা সিংহল রাজকে জানালে তিনি তা দেখতে চাইলেন। কিন্তু চন্ডীদেবীর মায়ায় ধনপতি তা দেখাতে পারে না। সিংহলে আগমনের পূর্বে ধনপতি খুল্লনা পূজিত চন্ডীর ঘট ভেঙ্গে দিয়েছিলো বলে চন্ডীদেবী তার ওপর ক্রোধান্বিত ছিলেন। তখন সিংহল রাজা শাস্তি স্বরূপ ধনপতিকে কারারুদ্ধ করেন।
ইতিমধ্যে, খুল্লনার এক পুত্র সন্তান জন্মগ্রহণ করে। তার নাম- শ্রীমন্ত। বড় হয়ে সে পিতার সন্ধানে সিংহল যাত্রা করলো। পথে শ্রীমন্ত ও কালিদহে কমলে কামিনী মূর্তি দেখতে পায়। কিন্তু পিতার মতো সেও সিংহলরাজকে তা দেখাতে ব্যর্থ হয়। রাজা অসন্তুষ্ট হয়ে তাকে মৃত্যুদন্ড প্রদান করেন। শ্রীমন্তের স্তরে চন্ডদেবী সন্তুষ্ট হয়ে তাকে রক্ষা করলেন। পিতা-পুত্রে মিলন ঘটলো। সিংহল রাজকন্যার সঙ্গে শ্রীমন্তের বিবাহ হলো। তারপর পুত্র ও পুত্রবধু সঙ্গে নিয়ে ধনপতি দেশে ফিরে আসে। উজানী নগরে এসে শ্রীমন্ত উজানী নগরের রাজাকে কমলে কামিনীর মূর্তি দেখিয়ে মুগ্ধ করলো এবং খুশী হয়ে রাজকন্যা জয়াবতীকে শ্রীমন্তের সাথে বিয়ে দিলো। কলিক মর্ত্যভূমিতে দীর্ঘকাল থাকা বড়ই কষ্টকর, এই সত্য বুঝিয়ে দেবী অবশেষে খুল্লনা, শ্রীমন্ত ও তার স্বর্গভ্রষ্ট দুই পতœী সুশীলা ও জয়াবতীকে নিয়ে স্বর্গে চলে গেলেন। তিনি ধনপতিকে এই সান্তনা দিলেন যে, তার প্রথমা স্ত্রী লহনার গর্ভে তার বংশধর পুত্র জন্মাবে। এভাবে ধনপতির নিকট স্বীকৃতি লাভ করে চন্ডীদেবী ব্রাহ্মণ্য আদর্শে গড়া সমাজে প্রতিষ্ঠিত হলেন।
সবশেষে এ কথাই প্রতীয়মান হয় যে, মধ্যযুগের বিস্তৃত বিচলিত সমাজে পরিবেশ সমস্ত ধ্বংস-প্রবণনাধর্মী প্রভাবের স্পর্শ থেকে আত্মরা করার জন্য এবং সেই পরিবেশে নিজের অকুতোভয় সত্ত্বাকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য মানুষ এই সীমাহীন শক্তির কামনা করেছে এবং এ কামনাই বাস্তব মূর্তি ধারণ করে চন্ডীতে ব্যঞ্জনা লাভ করেছে। আর সেই ব্যঞ্জনার মধ্যে আমরা লৌকিক জীবনের স্পন্দন অনুভব করছি।সহায়ক গ্রন্থপঞ্জিঃ-
১। চন্ডীমঙ্গল ঃ সম্পাদক- সুকুমার সেন।
২। মানব ধর্ম ও বাংলা কাব্যে মধ্যযুগ ঃ অরবিন্দ পোদ্দার।
৩। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস ঃ মাহবুবুল আলম।
৪। বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত ঃ ড. অসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়।লেখক ঃ- কথা সাহিত্যিক, কবি ও সাংবাদিক।