বাংলাদেশের খবরঃ বদলে গেছে বিএনপির রাজনীতির গতিপথ। চলছে আধিপত্য বিস্তার ও মাইনাস প্রক্রিয়া। ১/১১-তে দলটি থেকে খালেদা জিয়াসহ তার নেতৃত্ব মাইনাসের চেষ্টা করা হয়। তখনো বন্দি ছিলেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। বিএনপির ঘরে-বাইরে নেতাকর্মী এবং বন্ধুপ্রতিম দেশের প্রবল প্রতিরোধে সে প্রক্রিয়া ফাইলবন্দি হয়। ১২ বছর পর ফের ‘মাইনাস’ প্রক্রিয়াটি শুরু হয়েছে। ইতোমধ্যে ১৭ বছরের সাজাপ্রাপ্ত খালেদা জিয়া ১৬ মাস ধরে কারাবন্দি। তবে এবার ভিন্ন ফর্মুলায় খালেদা জিয়াকে মাইনাস করা হচ্ছে অর্থাৎ দলীয় প্রধানের সিদ্ধান্তকে মাইনাস করা হচ্ছে। ফলে বিএনপিতে আবারো খালেদাপন্থি ও তারেকপন্থি নামের দুই শিবির তৈরি হয়েছে। লক্ষ্য পূরণে ঘাপটি মেরে থাকা দলের সংস্কারপন্থিরা মাথাচাড়া দিয়েছেন। আধিপত্য বিস্তার করছেন দলে।
অন্যদিকে সক্রিয় হয়েছেন আলোচিত ‘হাওয়া ভবন’ সংশ্লিষ্টরা। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের অনেক সিদ্ধান্ত আসে তৎকালীন হাওয়া ভবনের দায়িত্বপ্রাপ্তদের কাছে। ফলে অন্ধকারে রয়েছেন দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্যরা। সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের আগ মুহূর্তেও তারা জানেন না। আর তিমিরে থাকার কারণে নেতাকর্মীদের অনেক প্রশ্নের জবাব এবং অনেক বিষয়ে সিদ্ধান্ত দিতে পারেন না বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। সম্প্রতি বেশ কয়েকটি ঘটনায় তিনি খালেদা-তারেক দুই শিবিরেই কোণঠাসা। তার ঘনিষ্ঠজনদের কাছে বিরাজমান অস্বস্তির কথা শেয়ার করেছেন।
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া গত বছরের ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে কারাবন্দি। ওই দিন জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হয়ে কারাবাস করছেন। ইতোমধ্যে জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায়ও সাজা হয়। সব মিলিয়ে ১৭ বছরের সাজা তার কাঁধে। মামলার সংখ্যা ৩৪টি। তার আইনজীবীরা স্পষ্টই বলছেন, খালেদা জিয়ার মামলা ও সাজা নিতান্তই রাজনৈতিক বিষয়। এটি সরকারপ্রধানের মতিগতির ওপর নির্ভর করছে। সাবেক আইনমন্ত্রী ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেছেন, আইনি প্রক্রিয়ায় খালেদা জিয়াকে মুক্ত করা সম্ভব নয়।
খালেদা জিয়ার বন্দিদশাতেই গত ৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। নির্বাচনের আগে জোটের পরিধি বৃদ্ধি, দল ও জোটের মধ্যে মনোনয়ন বণ্টন নিয়ে কারাগার থেকেই নানামুখী দিকনির্দেশনা দিয়েছিলেন খালেদা জিয়া। কিন্তু অনেক সিদ্ধান্তই বাস্তবায়ন হয়নি। দলের স্থায়ী কমিটি মনোনয়ন বোর্ডের দায়িত্ব পালন করলেও লন্ডন থেকে আসা সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত রূপ পেয়েছে। আবার ওই সিদ্ধান্ত সম্পর্কে জানতেন না বন্দি খালেদা জিয়া। লন্ডন থেকে তারেক রহমান বার্তা পাঠাতেন এবং এখনো পাঠান হাওয়া ভবনের সেই সমালোচিত ব্যক্তিদের মাধ্যমেই। দলের ত্যাগী, জনপ্রিয় নেতাদের মূল্যায়ন করা হয়নি। এ নিয়ে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ করা হয়েছে দলীয় ফোরামে। কোনো প্রতিকার না পেয়ে অনেক প্রভাবশালী নেতা রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয় হচ্ছেন।
নির্বাচনে ফল বিপর্যয়ের জন্য ক্ষমতাসীনদের দায়ী করেছে বিএনপি। কারাগার থেকে খালেদা জিয়ার নির্দেশনা ছিল- এই সরকারের অধীনে আর কোনো নির্বাচনেই যাবে না বিএনপি। এরপরই আসে উপজেলা ও স্থানীয় সরকার নির্বাচন। স্থায়ী কমিটির সভায় ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান নির্বাচনে অংশ নিতে বলেন।
এদিকে নির্বাচনে ৩০০ সংসদীয় আসনে ঐক্যফ্রন্ট ও ২০ দলীয় জোট থেকে দেওয়া প্রার্থীদের মধ্যে আটজন বিজয়ী হন। এর মধ্যে বিএনপি পায় ৬টি আসন। নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ থাকায় ওই ৬ বিজয়ীকে শপথ থেকে বিরত রাখার নির্দেশনা আসে কারাগার থেকে। কিন্তু দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ছাড়া বাকিরা শেষ সময়ে শপথ গ্রহণ করেন। শপথ গ্রহণকারী এমপিরা জানান, দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের নির্দেশেই তারা শপথ নিয়েছেন। স্বজনদের মাধ্যমে এ খবর পেয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী। আলোচনা ছিল সংসদে যোগদানের বিনিময়ে খালেদা জিয়ার মুক্তি মিলবে। সরকারের সঙ্গে এমন ‘সমঝোতা’ হয়েছে। কিন্তু তার ছিটেফোঁটা সত্যতাও মিলছে না।
এদিকে লন্ডনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ঝড় তোলেন তারেক রহমান। তারেকের এ কর্মকাণ্ডের পরিপ্রেক্ষিতে শেখ হাসিনা বলেন, তারেক রহমান বেশি বাড়াবাড়ি করলে তার মা জীবনেও জেল থেকে বের হবেন না। শেখ হাসিনা লন্ডন থেকে ফেরেন গত ১১ মে। আর খালেদা জিয়ার মামলার জন্য কেরানীগঞ্জে আদালত স্থানান্তর করার প্রজ্ঞাপন জারি হয় ১৩ মে।
সংসদে যোগদানকারী বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব হারুন অর রশিদ বাংলাদেশের খবরকে জানিয়েছেন, তাদের সংসদে পাঠানো হয়েছে; কিন্তু খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়ে আলোচনা করার কোনো নির্দেশ দেওয়া হয়নি। আলোচনা তিনিই (তারেক) করছেন।
সরকারের তরফ থেকে বলা হয়েছে, খালেদা জিয়ার মুক্তি মিলতে পারে দুই প্রক্রিয়ায়— একটি হলো রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা চেয়ে, অন্যটি প্যারোলের আবেদন করে। সরকার তো নিজে উদ্যোগী হয়ে প্যারোল দিতে পারে না।
এদিকে সাক্ষাতের সময় আইনজীবীদের কাছে নিজেকে নির্দোষ দাবি করে খালেদা জিয়া বলেছেন, তিনি কোনোভাবেই প্যারোলে মুক্তি নেবেন না। আইনের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়েছেন, ন্যায়বিচার পাবেনই। তবে দলীয় সূত্রের খবর, খালেদা জিয়াকে যেকোনোভাবে মুক্ত করার প্রস্তুতি চলছে।
বগুড়া-৬ আসনের বিজয়ী মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর শপথ না নেওয়ায় আসনটি শূন্য ঘোষণা করা হয়। ঘনিষ্ঠজনদের কাছে তিনি জানিয়েছেন, তার শপথ না নেওয়ার নেপথ্যে রয়েছে খালেদা জিয়ার প্রতি আনুগত্য এবং নিজের রাজনীতিতে টিকে থাকা। নীতি জলাঞ্জলি দিতে রাজি নন তিনি। ইতোমধ্যে ওই শূন্য আসনে উপনির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয়েছে। ওই নির্বাচনে অংশ না নিতে দলের প্রতি নির্দেশ ছিল খালেদা জিয়ার। কিন্তু হয়েছে উল্টোটা। খালেদা জিয়ার অনুমতির তোয়াক্কা না করে তার নামেই মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করা হয়েছে। তার মনোনয়ন বাদ পড়বে জেনেই বিকল্প হিসেবে আরো চারজনকে রাখা হয়েছে। আখেরে মনোনীত করা হবে সংস্কারপন্থিদের নেতা জিএম সিরাজকে। মনোনয়নপত্রে স্বাক্ষর নিতে গত বুধবার হাসপাতালে খালেদা জিয়ার কাছে যান তার আইনজীবী। এ সময় খালেদা জিয়া ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন, যারা উপনির্বাচনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে তাদের কাছে স্বাক্ষর নিন। খালেদা জিয়ার এ ক্ষোভের কথা ইতোমধ্যে জেনেছেন তৃণমূল নেতাকর্মীরা।
ময়মনসিংহ জেলা বিএনপি নেতা নাসির উদ্দিন বাংলাদেশের খবরকে বলেন, খালেদা জিয়া ৯০’র আন্দোলন করে ‘আপসহীন’ খেতাব অর্জন করেছেন। দলের কিছু নেতা তাদের স্বার্থে বিএনপি চেয়ারপারসনের খেতাবকে বিকিয়ে দিচ্ছেন। এর উদ্দেশ্য তাকে দল থেকে মাইনাস করা।
প্যারোলের প্রস্তুতি প্রসঙ্গে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ বাংলাদেশের খবরকে বলেন, খালেদা জিয়া এখনো প্যারোলে রাজি নন; তার শারীরিক অবস্থা ভালো নয়। সরকারও নমনীয় হচ্ছে না। তাই প্যারোলে রাজি করানোর চেষ্টা চলছে বলে জানান তিনি।
হাওয়া ভবনসংশ্লিষ্টদের সক্রিয়তায় ক্ষোভ প্রকাশ করে বিএনপির সাবেক এক প্রতিমন্ত্রী বলেন, দলের নেতাদের গুরুত্ব না দিয়ে যারা হাওয়া ভবনে কুকর্ম করে তারেক রহমানের ইমেজ নষ্ট করেছে তাদের গুরুত্ব দিলে শুধু দল নয়, তারও বারোটা বাজবে। তারেক রহমানের সাবেক পিএস মিয়া নুরুদ্দিন অপুকে গত নির্বাচনে কেন মনোনয়ন দেওয়া হলো, সে প্রশ্নের জবাব এখনো মেলেনি।
তারেক রহমানের বেশ কয়টি সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র্র রায়। এটা জেনে তাকে ফোন করেছিলেন তারেক রহমান। ফোনে দলের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে মাঠে-ঘাটে কথা বলতে নিষেধ করেন তিনি।
গতকাল এক প্রশ্বের জবাবে গয়েশ্বর চন্দ্র বলেন, চেয়ারপারসনের মুক্তির বিষয়ে সরকারের সঙ্গে যাদের আলোচনা হয়, তারাই সেটা জানেন। আমি জানি না। তবে বর্তমান সরকারকে যদি বাকিতে বিশ্বাস করা হয় তাহলে যা হওয়ার তাই হয়েছে।
-নিউজটি দৈনিক বাংলাদেশের খবর থেকে নিয়ে সখীপুর বার্তার পাঠকদের জন্য হুবুহু তুলে ধরা হয়েছে। মূল প্রতিকেদক: আফজাল বারী।