সাইফুল ইসলাম সানি: ‘একথা অনস্বীকার্য যে, সর্বস্তরের মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। এখন সব শ্রেণি-পেশার মানুষ স্বাধীনতার সুফল ভোগ করছে। বিশেষ সুবিধা ভোগ করছেন বীর মুক্তিযোদ্ধারাও। কেউ কেউ মুক্তিযোদ্ধা ভাতা বৃদ্ধি, সরকারি চাকরিতে সন্তানদের কোটা বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন ইস্যুতে কর্মসূচিতে যেতে চায়। আমার কাছে বিষয়টি খুবই বেমানান মনে হয়। কারণ, প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা বিশেষ সুবিধা না পেলেই মন খারাপ করার কথা নয়, দেশ স্বাধীন হয়েছে এটাই তাঁদের বড় পাওয়া।’
অনেকটা উত্তেজিত হয়েই কথাগুলো বলছিলেন- টাঙ্গাইলের সখীপুর উপজেলার ‘৭১ -এর বীর মুক্তিযোদ্ধা ও ‘৭৫ এ বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদকারী এসএম আবদুল হাকিম। তাঁর বাড়ি উপজেলার প্রতিমা বংকী গ্রামে।
অনেকটা নীরবে-নিভৃতেই দিন কাটছে প্রবীণ এই রাজনীতিক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা এসএম আবদুল হাকিমের। তিনি সখীপুর পাইলট উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক। অবসরের পর কেমন আছেন এসএম আবদুল হাকিম? এ খবর রাখে না কেউ। গ্রামের বাড়িতে টিভি দেখেই অধিকাংশ সময় পার করছেন তিনি। কথাবার্তা চাল-চলনে অদ্ভুত এক নীরবতা বিরাজ করে তাঁকে ঘিরে। একসঙ্গে বসে কথা বলার সঙ্গী খুঁজেন প্রতিনিয়ত, কিন্তু বয়সে প্রবীণ হওয়ায় অনেকেই মিশতে চায় না তাঁর সঙ্গে। ফলে অধিকাংশ সময়ই একাকিত্বে ভোগেন এক সময়ের শহর ও গ্রাম দাপিয়ে বেড়ানো এই প্রবীণ মুক্তিযোদ্ধা।
সম্প্রতি একান্ত আলাপচারিতায় সখীপুর বার্তার এ প্রতিবেদকের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বর্ণনা করেন বীর মুক্তিযোদ্ধা এস এম আবদুল হাকিম। তিনি বলেন, আমরা যুদ্ধ করেছি দুইবার। একবার করেছি মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের ঘটনার পর দ্বিতীয়বার করেছি প্রতিরোধ যুদ্ধ।
ভারিকণ্ঠে আতঙ্কের দিনগুলোর কথা স্মরণ করে তিনি বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের সময় আমার স্ত্রী সন্তানসম্ভবা ছিলেন। প্রথমবার সন্তানের বাবা হওয়ার খুশিতে যেমন ছিলাম; তেমনি ছিল মাথাভরা শঙ্কা! যেকোনো সময় স্ত্রীর প্রসব বেদনা উঠতে পারে। এ কারণে তাঁকে শ্বশুরবাড়ি মির্জাপুরের পাথরঘাটার দরানী পাড়ায় পাঠিয়ে দেই। বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে পাথরঘাটা যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর চিন্তা আরও বেড়ে যায়। পাথরঘাটা যুদ্ধ শেষ হলে শ্বশুরালয়ে গিয়ে দেখি আমার স্ত্রী প্রসব বেদনায় কাতরাচ্ছেন। ওই অবস্থায়ই দরানীপাড়া থেকে তাঁকে নৌকায় করে বহুদূর পূর্বদিকে নিয়ে গিয়ে এক আত্মীয়ের বাড়িতে আশ্রয় নিই। পাক-হানাদার বাহিনীর পাল্টা আক্রমণের ভয়ে ওই বাড়িরও বৃদ্ধ-বৃদ্ধা ছাড়া সবাই পালিয়ে গিয়েছিল। তারিখটি মনে নেই, সম্ভবত জুলাই মাসের শেষের দিকে হবে, ওই রাতেই আমার প্রথম পুত্র সন্তান পৃথিবীতে আসে।’ -এসব কথা বলতে বলতেই এক দীর্ঘশ্বাস ফেলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা এসএম আবদুল হাকিম। বলেন, সে ছিল এক দুঃসহ ভয়াল রাত্রি।
তিনি আরও বলেন, মুক্তিযুদ্ধে স্বেচ্ছাসেবক কমান্ডার হিসেবে ১৭০ জন সদস্য আমার দায়িত্বে ছিলেন। গ্রামে গ্রামে ঘুরে চাল, লাকড়ি সংগ্রহ করতাম। পরে সেই চাল, লাকড়ি গরুর গাড়িতে মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে রান্নার জন্য পাঠিয়ে দিতাম।
অধিকাংশ সময়ই বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম আমাদের সম্মুখ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে মানা করতেন। তিনি বলতেন, সখীপুরে যেনো রাজাকার তৈরি না হয় এ বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে। মুক্তিবাহিনী গ্রামের লোকজনের সঙ্গে কেমন আচরণ করে সে বিষয়ে খোঁজখবর রাখতে হবে। গ্রামের লোকজন যেনো ভয় না পায় সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে, তাঁদের সাহস দিতে হবে।
১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার প্রতিবাদে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে আমরা পুনরায় যুদ্ধ ঘোষণা করি। বাড়িতে গোলাবারুদ মজুত রাখার কারণে ১৯ নভেম্বর আমাকে গ্রেপ্তার করা হয়। অমানুষিক নির্যাতনের শিকার হয়েছিলাম। পরে চার বছর কারাভোগের পর ছাড়া পাই।
তিনি আরও বলেন, এখন বয়স হয়েছে, চাওয়া-পাওয়ার কিছু নেই। দেশ ভালোভাবে চললেই ভালো লাগে, এর চেয়ে বেশি কিছু চাওয়ার নেই।
শেষ চাওয়ার মাধ্যমেও তিনি একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা, দেশপ্রেমিক ও রাজনীতিবিদের পরিচয় দিলেন। জীবদ্দশায় কখনো সুযোগ পেলে প্রধানমন্ত্রীর কাছে সখীপুরের ১৪ মৌজার খাজনা বাস্তবায়নের বিষয়ে আলাপ করবেন। এটি সখীপুরের আপামর জনসাধারণের প্রাণের দাবি।
তিনি শঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, সম্ভবত জমির খাজনার বিষয়টি নিয়ে মানবিক প্রধানমন্ত্রীর কাছে বারবার ভুল তথ্য যাচ্ছে। দেশের বহু জায়গায় এর সমাধান হয়েছে, কিন্তু এক অজানা কারণে আমাদের সখীপুরের ১৪ মৌজার খাজনা আদায় বন্ধ রয়েছে। মৃত্যুর আগে আমাদের শত বছরের ভোগ দখলীয় নিজস্ব জমির খাজনা দিতে পারলে শান্তিতে মরতে পারবো বলে দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন তিনি।
–বার্তা ডেস্ক