আলীম মাহমুদ জুনিয়র :
সখীপুর নাকি সখিপুর? দ্বিধা-দ্বন্ধ আর তর্কে বহুদূর। ই-কার নাকি ঈ-কারে আসল সখীপুর? ই-কার কিংবা ঈ-কার, যেকারেই লিখিনা কেন ভুল কেউ ধরছেনা, তাহলেকি ভুল হচ্ছেনা? যে যার মত ই-কার কিংবা ঈ-কার ব্যবহার করে লিখছে, তাই চলছে দেধারছে। সখীপুর বানানের এই দ্বিধা-দ্বন্ধ কি সখীপুর সৃষ্টিলগ্ন থেকেই ছিল নাকি কালের বিবর্তনে, লোকের পরিবর্তনে, ক্ষমতার আবর্তনে দ্বিধা-দ্বন্ধে পড়েছে সখীপুর বানানটি?
৭১’র মুক্তিযুদ্ধের চারণ ভূমি সখীপুর। কাদেরীয়া বাহিনীর সূতিকাগার সখীপুর। লাল মাটির সখীপুর। আমাদের পাহাড় সখীপুর। যদিও এখানে পাহাড় নেই আছে শুধু বিস্তীর্ণ সমতল ভূমি। সেই পাহাড়ী লালমাটিই আমার জন্মভূমি, আমার বিচরণ, শেষ ঠিকানাও যেন হয় এই লালমাটিতেই এটাই প্রত্যাশা। ‘সখীপুর আমার সখীপুর/ হৃদ ক্যানভাসে লিখেছি একটি গান, একটিই তাঁর সুর/ সখীপুর আমার প্রিয় সখীপুর/ হৃদজমিন আর লালমাটির নেইতো বেশি দূর’। ছায়া সুনিভীর ঘেরা সবুজ প্রকৃতি, দু’পাশে রাশি রাশি ধানক্ষেত বাতাসে খায় দোল আর মাঝখান দিয়ে সাপের মত একেবেঁকে চলে গেছে পা’পথ। শাল অরণ্যে যেন এক অপরূপ সৌন্দর্য লীলাখেলার পূণ্যভূমি সখীপুর। এই ঐতিহাসিক সখীপুরকে নিয়েই আমাদের গর্ব, আমাদের গৌরব, আমাদের অহঙকার।
বাসাইল থেকে পৃথক হয়ে ১৯৭৬ সালে যখন সখীপুর থানা প্রতিষ্ঠিত হয় তখন গেজেট অনুযায়ী সখীপুর বানান ছিল ই-কার দিয়ে। তথ্যসূত্রে জানা যায় ঐ সমসাময়িক কাগজপত্রেও সখীপুর বানানটি ছিল ‘সখিপুর’। এরপর ১৯৮৬ সালে সখীপুর উপজেলা প্রতিষ্ঠিত হয়। উপজেলা প্রতিষ্ঠার সময়ও গেজেটে লেখা হয় ‘সখিপুর উপজেলা’। ২০০০ সালে পৌরসভায় উন্নীত হয় সখীপুর। সেই কাগজপত্রেও লেখা হয় ‘সখিপুর পৌরসভা’। বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের নির্বাচনী এলাকা হিসেবে লেখা হয় ১৩৭, টাঙ্গাইল-৮ (বাসাইল-সখিপুর)। জাতীয় তথ্য বাতায়নে সখীপুর বানানটি লিখেছে ই-কার দিয়ে ‘সখিপুর উপজেলা’। উইকিপিডিয়া কিংবা গুগল সখীপুর বানান লিখছে ‘সখিপুর’। টাঙ্গাইল জেলার তথ্য বিবরণীর ওয়েবসাইটে সখীপুর বানানটি লেখা হয়েছে ই-কার দিয়ে। এছাড়া বিভিন্ন সরকারি চাকরির অনলাইন আবেদনে সখীপুর বানানটি প্রদর্শন করে ই-কার দিয়ে। সর্বপ্রধান যে বিষয়টি লক্ষণীয় ১৯১৫ সালের (সিএস) ম্যাপ অনুযায়ী জমির দলিলে কিংবা পর্চায় সখীপুর বানানটি লেখা আছে ই-কার দিয়ে। করটিয়ার জমিদাররা যখন এই সখীপুর অঞ্চল শাসন করতো এবং জমির খাজনা আদায় করতো তখন তাঁদের নবাবী দলিলে সখীপুর বানান ছিল ই-কার দিয়ে এবং ঐ সময়কার জমির দলিলে সখীপুর বানান ই-কার দিয়েই লেখা হতো। পরে ১৯৬২ সালের দিকে জমি-জমা আরওআর/আরএস (রিভিউনাল সার্ভে) হিসেবে গণ্য হয়। সেখানেও সখীপুর বানান লেখা হয় ই-কার দিয়ে। রেকর্ডভূক্ত মালিকানা জমি-জমার দলিলেও সখীপুর বানানটি ই-কার দিয়েই লেখা। বন বিভাগের জায়গা-জমিতে কিংবা মৌজায় লিখছে ই-কার যুক্ত সখীপুর।
উপজেলা পরিষদ, উপজেলা প্রশাসন, পৌরসভা, থানা, কিংবা ভূমি অফিস কাগজপত্রে যাই থাকুক না কেন তাঁরা তাঁদের সাইনবোর্ড, সীল এমনকি অফিসিয়াল প্যাডে ব্যবহার করছেন ঈ-কার যুক্ত সখীপুর। এত কিছুর পরেও আমরা সখীপুরবাসী সখীপুর বানানটি ঈ-কার দিয়েই লিখতেই বেশি ভালোবাসি। যদিও আধুনিক বাংলা বানানে ঈ-কারের ব্যবহার অনেকাংশে কমে গেছে, নাই বললেই চলে। অনেক জনপ্রিয় ঈ-কার যুক্ত বানানগুলোও ইদানীং লেখা হয় ই-কার দিয়ে যেমন প্রতিযোগিতা (প্রতিযোগীতা), পরিক্ষা (পরীক্ষা), শ্রেণি (শ্রেণী) এমন আরও অনেক। বাংলা বানানের এই আধুনিকতার যুগেও আমরা
সখীপুর বানানটি ঈ-কার লিখতেই ভালোবাসি। ঈ-কার যুক্ত সখীপুর বানানে যেন মায়া পরে গেছে আমাদের সখীপুরবাসীর। সখী থেকে যদি সখীপুর হয় তাহলে ঈ-কার যুক্ত সখীপুর যেন ঘোমটা পড়া সখী আর ই-কারে মনে হয় অনেকটাই অনাবৃত। যদিও আধুনিক বাংলা বানানে সখি বানানটি ই-কার দিয়েই লিখতে হয়। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, হুমায়ুন আজাদ কিংবা সৌমিত্র শেখর যদি আমাদের এই সখীপুরে জন্মাতেন তাহলে হয়তো তাঁরা বাংলা একাডেমিতে বসেই ঠিক করে দিতেন সখীপুর বানানটি। ওনারা হয়তো সখীপুরকে চিনেনই না
হয়তো নামই শুনেন নাই সেজন্যই হয়তো সখীপুর নিয়ে ভাবেনই নাই। তাই বলেকি আমাদের সখীপুরে শিক্ষাবিদ, গবেষক কিংবা সাহিত্যিক নেই? আছে. আমাদেরও আছে, সখীপুরবাসীরও আছে প্রফেসর মুহম্মদ শামসুল হক, ড. লুৎফর রহমান, প্রফেসর আলীম মাহমুদের মত দেশ আলোকিত শিক্ষাবিদ ও গবেষক। তাঁরাও চাইলে হয়তো একটি বানানে সখীপুর লিখতে পারবে সখীপুরবাসী। শুধু একটি উদ্যোগ আর উদ্যোক্তার অভাব।
‘যেখানেই যাই সখীপুর সঙ্গে সঙ্গে থাকে/ স্বপ্ন আর চৈতন্যের ঠিক মাঝামাঝি সখীপুর’ ‘শহর থেকে দূরে হলেও, সভ্যতা থেকে নয়তো বহুদূর’ -বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশন (বিপিএসসি)-এর বর্তমান চেয়ারম্যান ড. মাহবুব সাদিকের কবিতার এই লাইন আমার বিশ্বাস বুকে ধারণ করেন প্রত্যেক সখীপুরবাসী। কবিতা পড়ে বোধ করেন নয়তো না পড়েই হৃদয়ে ধারণ করেন। সখীপুরবাসীর হৃদয়ের ভাবনাটাই যেন প্রকাশ পেয়েছে এ কবিতায়। এখানে আমরা সখীপুর বানানটি দেখতে পাই ঈ-কার দিয়ে লেখা। আবার ‘সখীপুর আমার গৌরব, আমার শত জনমের অহঙকার’ তিলোত্তমা সখীপুরের রূপকার, সখীপুর-বাসাইলের চার(৪)বার নির্বাচিত সংসদ সদস্য, প্রয়াত কৃষিবিদ শওকত মোমেন শাহজাহানের এই বাণীর বলিষ্ঠ উচ্চারণ যখনই কানে ভেসে আসে কিংবা কোথাও লেখা দেখি তখনই বুকটা গর্বে ভরে উঠে। আমরা আমাদের সখীপুরবাসীর গর্বের এ বাণীতে সখীপুর বানানটি দেখতে পাই ঈ-কার দিয়ে লেখা এবং তিনি তাঁর জীবদ্দশায় যতবার যত জায়গায় সখীপুর বানানটি লিখেছেন প্রত্যেকবারই ঈ-কার দিয়েই লিখেছেন। বর্তমান স্থানীয় সংসদ সদস্য জনাব অনুপম শাহজাহান জয়ও ঈ-কার যুক্ত সখীপুর লেখার পক্ষে। খুদ আমি নিজে লেখাটি সম্পাদন করলাম ঈ-কার যুক্ত সখীপুর দিয়েই। সখীপুরে লোকমুখে প্রচলিত আছে, সাধারণত সখীপুরের আওয়ামী
লীগ পন্থিরা সখীপুর বানানে ঈ-কার ব্যবহার করে থাকেন, কারন আওয়ামী লীগ লিখতে ঈ-কারের ব্যবহার হয়ে থাকে পক্ষান্তরে সখীপুরের বিএনপি পন্থিরা সখীপুর বানানে ই-কার ব্যবহার বেশি করে থাকেন। কারন স্বরূপ দাঁড় করানো হয় বিএনপি শব্দটি লেখা হয় ই-কার দিয়ে। এমন হাজারো প্রচলিত কথার ভীরেও আমরা সখীপুর নিয়ে দ্বিধা-দ্বন্ধ চাইনা। আমরা চাই আমাদের আত্মিক শান্তির সখীপুর। ই-কার নাকি ঈ-কার? কোন কারে আমাদের আসল আত্মিক শান্তি সেইটা খুজে আমরা কি পারিনা দ্বিধা দ্বন্ধের উর্ধ্বে লেখার জন্য একটি শব্দ নির্ধারণ করতে সখীপুর নয়তো সখিপুর। সখীপুরের সর্বময় ক্ষমতা ভোটাধিকারের মাধ্যমে যাদের হাতে দিয়েছেন সখীপুরবাসী সেই জনপ্রতিনিধিরা কিংবা শিক্ষাবিদ, কবি-সাহিত্যিক, গবেষক, সুশীল সমাজ, সুনাগরিক, সচেতন সখীপুরবাসী কি পারেন না অন্তত সখীপুর বিষয়ে দল-মতের বাইরে একমত হয়ে লেখার জন্য ই-কার অথবা ঈ-কারের একটি সখীপুর বানান নির্ধারণ করতে? আমাদের প্রিয় সখীপুরে নেই বলে কিছু নেই, সব দিক থেকেই স্বয়ংসম্পূর্ণ আমরা। আমরা কেন পারবোনা সবাই মিলে একটি বানানে সখীপুর লিখতে? আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মের কোমল মতি শিশুদের কথা একবার ভাবুন ! যাদের মুখে বোল ফুটেছে সবেমাত্র। স্কুলে যাই যাচ্ছে করছে। নিজের নাম, বাবার নাম, মায়ের নাম এবং ঠিকানা লেখা শিখছে। একজন শিখছে সখীপুর অন্যজন শিখছে সখিপুর। স্কুলে যাবার পর একজন অন্যজনেরটা দেখে বলছে তোরটা ভুল, ও বলছে তোরটা ভুল। এনিয়েই ঝগড়া, বিচার…. শিক্ষক কিংবা অভিভাবক পড়ছেন বিপাকে। আসলে ভুলটা কার?
সখীপুর বাজারে এবং আশেপাশে তাকালেই আমরা অজ¯্র সখীপুর শব্দটি ব্যবহার করা ব্যনার পোস্টার দেখতে পাই। যেখানে সখীপুর বানানটি ই-কার এবং ঈ-কার দুইভাবেই লেখা হয়ে থাকে। বাচ্চারা যখন স্কুলে যাওয়া শুরু করে খেয়াল করে দেখবেন আশেপাশের লাগানো পোস্টারগুলো বানান করে পড়া শুরু করে। এটা সব বাচ্চাদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। তাহলে ওই বাচ্চারা একেক ব্যনারে একেক রকম সখীপুর বানান দেখলে কোনটা সঠিক আর কোনটা ভুল ভেবে শিখবে? সময় কি হয়নি এখনও সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার। একটি সখীপুর বানান নির্ধারণ করার? আজ আমার সন্তান দ্বিধা-দ্বন্ধে পড়ছে, কাল আপনার সন্তান পড়বে, পরশু তাঁর সন্তান পড়বেনা তা কিন্তু নয়? তাই এখনই সময়, আসুনএ আমরা একটি বানানে একটি অখন্ড, উর্বর, পরিষ্কার ও উন্নত সখীপুর গড়ে তুলি।
-আলীম মাহমুদ জুনিয়র
প্রভাষক, সরকারি মুজিব কলেজ, সখীপুর।
নির্বাহী সম্পাদক, সখীপুর বার্তা।