উদীয়মান ফটোগ্রাফার জাহিদ হাসান। শৈশব থেকেই বড় ফটোগ্রাফার হওয়ার ইচ্ছা মনে। তাই সময়ের ব্যবধানে ছবি তোলাটাই তার হয়ে গেছে নেশা। এভাবেই ফটোগ্রাফিতে যাত্রা শুরু তার। টাঙ্গাইলের সখীপুর উপজেলার কাহারতা গ্রামে জন্ম জাহিদ হাসানের। বর্তমান উপজেলার সরকারি মুজিব কলেজে বিবিএস প্রথম বর্ষে পড়ালেখা করছেন জাহিদ। বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশ গ্রহণ করে সেরা হয়েছেন। তরুণ এই ফটোগ্রাফারের জীবনের গল্প নিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করেছেন সখীপুর বার্তা’র উপ-সম্পাদক মামুন হায়দার।
জাহিদ হাসান জানান, আমি পড়াশুনার পাশাপাশি ফটোগ্রাফি করছি। আমার প্রথম ছবি প্রদর্শণী অনুষ্ঠিত হয় ২০১৬ সালের ২৭ থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে। জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ফটোগ্রাফি সোসাইটির (জেইউপিএস) Step Out JUPS Inter University Photography Exhibition। স্কুল জীবনে কখনো কোন ক্লাসে রোল নম্বর এক বানাতে পারিনি। লেখাপড়ায় সারা বছরই অমনোযোগি ছিলাম। তবে বাবা মায়ের মন জয় করার মতো রেজাল্ট আমার ছিল। জীবনে কখনোও কোন বিষয়ে কোন ক্লাসে ফেল করিনি। সব সময় ইচ্ছে ছিল ভালো কিছু করার। একজন ভাল মানুষ হওয়ার। যখন নিজেকে অনেক মানুষের মধ্যে আবিষ্কার করি তখন নিজেকে বালুকণার মতো ছোট মনে হয়। কিন্তু, যখন অনেক মানুষের ভিড়ে নিজেকে একটু আলাদারূপে আবিষ্কার করি তখন নিজেকে অনেক বড় বড় লাগে। ওই প্রদর্শণীতে বাংলাদেশের প্রায় ৩,১৭৫ টি ছবি প্রতিযোগিতার জন্য জমা পড়েছিল। তার মধ্য থেকে সবচেয়ে সেরা ১০০ টি ছবি প্রদর্শণীর জন্য নির্বাচিত করা হয়েছিল। সেরা ১০০ টি ছবির মধ্যে আমার তোলা ‘ঝালমুড়িওয়ালার শীতের সকাল’ শিরোনামের ১টি ছবিও জায়গা করে নিয়েছিল। তখন নিজেকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। সেই থেকে অনেক বেশী অনুপ্রেরণা পাই। তারপর আর থেমে থাকতে হয়নি। পরের মাসেই আমার তোলা ‘কিছু পাওয়া থাকে যা কিনা সবার উপরে, কিছু হাসি থাকে যা কিনা সবার উপরে’ শিরোনামের ছাতা মাথায় দুটি তাল হাতের একটি ছোট্ট ছেলের ছবি স্থান করে নেয় পোরট্রেইট ক্যাটাগরিতে। Exploring The World Of Creations-Season 2 নামের প্রদর্শণীতে। যেটি আয়োজন করেছিল ফেসবুক ভিত্তিক গ্রুপ Photography 24X7 প্রদর্শণীটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল ধানমন্ডির দৃক গ্যালারীতে গত ১৩ থেকে ১৫ অক্টোবর। এরপর গত ২ থেকে ৩ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত খুলনা ফটো গ্যালারি (কেপিজি) আয়োজিত ‘শীতের সকালে গ্রাম্য ছেলে বিলের মাছ ধরতে যাচ্ছে’ শিরোনামে আমার তৃতীয় ছবি প্রদর্শণীতে স্থান করে নেয়।
জাহিদ হাসান আরও জানায়, ফটোগ্রাফি করা আমার শখ। সেই শখের ফটোগ্রাফির যে প্রাপ্তি তা সত্যিই অনেক ভালো লাগার। এই ভাললাগাটা শুধুই অনুভবের। এটা লিখে বা বলে প্রকাশ করার মতো উপযুক্ত শব্দও খুঁজে পাচ্ছি না। শুধু এইটুকুই বলতে চাই, এই স্বীকৃতি আমাকে আরো ভালো ছবি তোলার জন্য উৎসাহ যোগায়। নির্বাচিত ছবিগুলোর পেছনের অনেক কথা। একটি ছবির পেছনে হাজারও গল্প থাকে। সে জানায়, ছোট বেলায় প্রতিবেশি অনেকের হাতেই দেখতাম ভালো মানের স্মার্টফোন আর ক্যামেরা। তারা আনন্দে-উল্লাসে ছবি তুলছেন। ভাবতাম ফোন আর ক্যামেরা থাকলে আমার তাদের মতোইতো আনন্দ-উল্লাস থাকতো। একেতো দরিদ্র পরিবারের সন্তান। কিন্তু কৃষক বাবাকে এসব বললে কোথা থেকে কিনে দেবে একটি ক্যামেরা? তাই মনে অনেকটাই জেদ চেপে রেখেছি। সে অনেক কথা। স্কুল ও কলেজে পড়ার সময় টিফিনের ৫/১০ টাকা করে জমাতে থাকি। ওই টাকা ও বাবা-মায়ের কিছু সহযোগিতা পেয়ে ২০১৬ সালে লেন্স ক্যামেরা কিনেছি। তারপর বাইসাইকেলে চড়ে ক্যামেরা নিয়ে ছবির পেছনে ছুটে চলা। প্রতিবেশিদের ব্যাপারে কৌতূহল মেটাতে গিয়েই ছবি তোলাটা এক প্রকার শখে পরিণত হলো। সেই শখটাই পরে আমার জীবনের সঙ্গে মিশে গেছে। আর আমি ফটোগ্রাফিকে পেশা হিসেবে নেইনি এখনও, ফটোগ্রাফি আমার নেশা। তবে ভবিষ্যতে অনেক বড় ফটোগ্রাফার হওয়ার ইচ্ছা আছে।
ভালো ফটোগ্রাফার হওয়ার জন্য আসলে কী দরকার – দামি ক্যামেরা নাকি অন্য কিছু? জানতে চাইলে জাহিদ জানান, কেউ যখন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা-গল্প-উপন্যাস পড়েন, তখন কেউ কি ভাবেন তিনি কত দামি কলম দিয়ে গল্পটি লিখেছেন! একইভাবে আমি বলতে চাই কত দামি ক্যামেরা বা লেন্স দিয়ে ছবি তুললেন সেটার চেয়ে বড় বিষয় হল আপনার ছবি কি কথা বলে। শুধু বড় লেন্স দামি ক্যামেরা নিয়ে ঘুরলেই যে কেউ ফটোগ্রাফার হয়ে গেল, বিষয়টা এমন না। ভালো মানসম্পন্ন ছবি তুলতে হবে, ছবির বিষয়বস্তু হতে হবে অর্থপূর্ণ। আর ভালো ছবি তোলার জন্য সব সময় অনুশীলন করা জরুরি। অনেক ছবি তুলতে হবে, ছবির ব্যাকরণ বিষয়ে পরিষ্কার ধারণা থাকতে হবে। ভালো ফটোগ্রাফারদের প্রসিদ্ধ ছবিগুলো দেখতে হবে এবং ছবির কারিগরি ও শৈল্পিক কলাকৌশল বোঝার চেষ্টা করতে হবে। আসলে খুব সহজে একজন ভালো ফটোগ্রাফার হওয়া যায় না। ভালো ফটোগ্রাফার হওয়ার শর্টকাট কোনো রাস্তা নেই। ধৈর্য, আগ্রহ ও চেষ্টার সমন্বয়েই সম্ভব ভালো ছবি তোলা। ভালো ফটোগ্রাফার হতে সময় লাগে। একজন ভালো ফটোগ্রাফার হতে গেলে আগে তাকে ভাল মানুষ হতে হবে। আমি নিজে নিজে ইন্টারনেট বা অনলাইন ঘেঁটে ফটোগ্রাফার বিষয়ে শিখেছি।
ফটোগ্রাফার হতে হলে কী কী বিষয়ের দিকে নজর রাখতে হয় এ বিষয়ে জাহিদ জানান, একজন ফটোগ্রাফারকে ছবি তোলার আগে অনেক বিষয় খেয়াল রাখতে হয়। যেমন, ফটোগ্রাফিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে ‘আলো’। ফটোগ্রাফি মানেই আলোর খেলা। তাই ছবির দৃশ্যে প্রথমেই আলোর উৎস, পরিমাণ, প্রতিফলন ইত্যাদি নিয়ে ভাবতে হবে। Exposure সেটিং-এ আইএসও যত কম রাখা যায় ততই ভালো। বেশি আইএসও ছবিতে নয়েজ সৃষ্টি করে। ছবি তোলার আগে সাবজেক্ট, আলো, ব্যাকগ্রাউন্ড, ভিউ অফ অ্যাঙ্গেল, এক্সপোজার খেয়াল করতে হবে। সম্ভব হলে সময় নিয়ে দৃশ্য ও সাবজেক্টের অনুকূলে ক্যামেরার ফিচার ও কম্পোজার সেটিং করে নিতে হবে। আর কালার সাবজেক্টের কালারের চেয়ে যেন উজ্জ্বল না হয়।
তরুন আলোকচিত্রী জাহিদ হাসান। শখের বসে ছবি তোলেন। কাঁধে ক্যামেরা ঝুলিয়ে বাইসাইকেলে চড়ে ছবির পেছনে ঘুরে বেড়ান গ্রামে গ্রামে। এবারই প্রথম তার তোলা ছবির স্থান মিলেছে রাজধানীর শিল্পকলা একাডেমি ও ধানমন্ডির দৃক গ্যালারিতে এবং খুলনার জিয়া হলে। তার ভাষ্যমতে,‘ তরুনরাই এ সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। তাদের অসামান্য প্রতিভাকে সমাজ উন্নয়নে কাজে লাগাতে পারলে সমাজের অসঙ্গতিগুলো কমে আসবে। ছবি তোলা একটি শিল্প। একটা ভালো ছবি সময়কে ফ্রেমে আবদ্ধ করে রাখে।’ একটি ভালো ছবি আমাদেরকে অনুপ্রেরণা যোগায়। তরুন এ আলোকচিত্রীর সুন্দর ছবি দিয়ে মানুষকে সচেতন করে তুলবে। এ প্রত্যাশা আমাদেরও।