আলীম মাহমুদ জুনিয়র :

স্কুলের পাঠ্যবইয়ে “ঝিঙেফুল”,“লিচুচোর” কিংবা “খুকী ও কাঠবিড়ালী” পড়তে পড়তে বাল্যকালেই পরিচয় কবি নজরুলের সাথে। সেই থেকে শুরু; তারপর- “সঞ্চিতা”,“অগ্নিবীণা”, “চক্রবাক”, “ফণীমনসা”, “নতুন চাঁদ”, “মরুভাস্কর”, “সঞ্চয়ন” কাব্যগ্রন্থে; “ব্যথার দান”, “রিক্তের বেদন”, “শিউলিমালা” ছোট গল্পে; “বাধনহারা”, “কুহেলিকা”, “মৃত্যুক্ষুধা” উপন্যাসে কিংবা হাজারো নজরুল গীতিতে বারবার পরিচয় হয় এই মরমী কবির সাথে। এই বিদ্রোহী কবির সাথে। এই সাম্যের কবির সাথে। এই মনুষত্ব আর মানবিকতার কবির সাথে।
১৮৯৯ সালের ২৪ মে ( ১১ জ্যৈষ্ঠ ১৩০৬) বুধবার, বর্ধমান জেলার আসানসোল মুহকুমার তৎকালীন রাণীগঞ্জ থানার অন্তর্ভুক্ত চুরুলিয়া গ্রামের কাজী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন বিংশ শতাব্দীর অন্যতম জনপ্রিয় বাঙালি কবি, সঙ্গীতজ্ঞ, সঙ্গীত¯্রষ্টা, দার্শনিক, কবি কাজী নজরুল ইসলাম। ঝাঁকড়া চুলের বাবরী দোলানো এ কবির জন্মই হয়েছিলো হয়তো আমাদের বিবেক ও চেতনাকে নাড়িয়ে দেয়ার জন্য। তিনি একাধারে বিদ্রোহের কবি, সাম্যের কবি, উত্তরণের কবি, মানুষ ও মনুষত্বের কবি, চেতনার কবি, জাগরণের কবি, তিনি অসহায় নিপিড়ীত মানুষের কবি এবং প্রেমিক হৃদয়ের কবিও বটে। নিগৃহীতের জন্য কেঁদেছে তাঁর মন, এক হাতে তুলেছিলেন বাঁশের বাঁশরী, আরেক হাতে রণ-তূর্য্য। আসলেই এত বহুমূখী প্রতিভার অধিকারী এই অমর কবির উপমা দেবার মত শব্দাবলী বড় দূর্লভ।
১৯০৮ সালের ২০ মার্চ কাজী নজরুল-এর পিতা কাজী ফকির আহমেদ মৃত্যুবরণ করেন। তখন তাঁর বয়স মাত্র নয় বছর। আর্থিক অভাবে শিক্ষা জীবন বিঘিœত হয়। খুব ছোট বয়সেই মসজিদে ইমামতি, মাজারের খাদেম ইত্যাদি করে জীবিকা নির্বাহ করেন এই বরেণ্য কবি। মক্তব, মসজিদ ও মাজারের কাজ ছাড়াও বাল্য কালেই রোক শিল্পের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে লেটো দলে যোগ দেন। তাঁর চাচা চুরুরিয়া আসানসোলের লেটো দলের ওস্তাদ ছিলেন। ধারণা করা হয় তাঁর চাচার প্রভাবেই তিনি রেটো দলে যোগ দেন। সেখানেই তিনি সাহিত্য কর্ম শুরু করেন। এই দরের সাথে তিনি বিভিন্ন যায়গায় যেতেন, অভিনয় শিখতেন,নাটকের জন্য গান, কবিতা লিখতেন। নিজ কর্ম ও অবিজ্ঞতার আরোকে তিনি বাঙলা ও সংস্কৃত অধ্যয়ন শুরু করেন। সেই অল্প বয়সেই নাট্যদলের জন্য বেশ কিছু লোকসঙ্গীত রচনা করেন। কৈশোরে বিভিন্ন থিয়েটার দলের সাথে কাজ করতে যেয়ে তিনি কবিতা, নাটক এবং সাহিত্য সম্বন্ধে জ্ঞান লাভ করেন। কাজী নজরুল ইসলামের ডাক নাম “দুখু মিয়া”।
১৯১০ সালে লেটো দল ছেড়ে আবার ছাত্র জীবনে ফিরে আসেন। আবারও আর্থিক সমস্যার কারণে ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত পড়ে তাঁকে আবার কাজে ফিরে যেতে হয়। প্রথমে বাসুদেবের কবিদলে, এরপর একজন খ্রিস্টান রেলওয়ে গার্ডের খানসামা এবং সর্বশেষ আসানসোলের রুটির দোকানেও কাজ নিতে হয়। এই রুটির দোকানে কাজ করার সময় আসানসোলের দারোগা রফিজউল্লাহ’র সাথে তাঁর পরিচয় হয়। দোকানে বসে নজরুল যেসব ছড়া ও কবিতা রচনা করতেন তা দেখে রফিজউল্লাহ তাঁর প্রতিভার পরিচয় পান। ১৯১৪ সালে ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশালের দরিরামপুর হাইস্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি করে দেন এই রফিজউল্লাহ দারোগা। ১৯১৭ সালের শেষদিকে মাধ্যমিকের প্রি-টেষ্ট পরীক্ষার আগেই তিনি সৈনিকের চাকরিতে যোগ দেন। ১৯১৭ থেকে ১৯২০ এর মার্চ-এপ্রিল পর্যন্ত তিনি সেনাবাহিনীতে ছিলেন। এর মধ্যে তিনি সেনানিবাসে বসেই “বাউন্ডেলের আত্মকাহিনী” (প্রথম গদ্য রচনা), “মুক্তি” (প্রথম প্রকাশিত কবিতা), গল্প; “হেনা”, “ব্যথার দান”,“মেহের নেগার”, “ঘুমের ঘোরে, “কবিতা সমাধি” ইত্যাদি রচনা করেন। তাঁর কবিতায় বিদ্রোহী মনোভাবের কারণে তাঁকে বিদ্রোহী কবি আখ্যায়িত করা হয়েছে। তাঁর সেনানিবাসে বসেই “বাউন্ডেলের আত্মকাহিনী” (প্রথম গদ্য রচনা), “মুক্তি” (প্রথম প্রকাশিত কবিতা), গল্প; “হেনা”, “ব্যথার দান”,“মেহের নেগার”, “ঘুমের ঘোরে, “কবিতা সমাধি” ইত্যাদি রচনা করেন। তাঁর কবিতায় বিদ্রোহী মনোভাবের কারণে তাঁকে বিদ্রোহী কবি আখ্যায়িত করা হয়েছে। তাঁর কবিতার মূল বিষয়বস্তু ছিল মানুষের উপর মানুষের অত্যাচার এবং সামাজিক অনাচার ওশোষণের বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রতিবাদ। একাধারে কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, সম্পাদক, সঙ্গীতজ্ঞ, রাজনীতিবিদ এবং সৈনিক হিসেবে অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে কাজী নজরুল সর্বদাই ছিলেন সোচ্চার।
মূলত লেখক হিসেবে কবি নজরুলের আত্ম প্রকাশ ঘটে “বাউন্ডেলের আত্মকাহিনী” এর মাধ্যমে ১৯১৯ সালে। ১৩২৬ সালের জ্যৈষ্ঠ সংখ্যা মাসিক “সওগাত” প্রকাশ করে এই রচনা ও “মুক্তি” কবিতা। ১৯২০ সালে“মোসলেম ভারত” পত্রিকায় বাধনহারা উপন্যাস ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ হয়। এরপর থেকে মুজাফফর আহমেদের সঙ্গে তিনি “ দৈনিক নবযুগ” পত্রিকা সম্পাদনার কাজে নিযুক্ত হন।
১৯২১ সালে নার্গিস আসার খানমের সাথে বিয়ে হয় নজরুলের, কিন্তু ঘরজামাই থাকতে রাজি না হওয়ায় তিনি চলে আসেন বাসর সম্পন্ন না করেই। তারপর ১৯২৪ সালে ২৫ এপ্রিল আশালতা সেন গুপ্তাকে বিয়ে করেন, বিয়ের পর তিনি আশালতার নাম দেন প্রমীলা। ১৯২২ সালে ৬ জানুয়ারি সাপ্তাহিক “বিজলী’ এবং “মোসলেম ভারত”-এর কার্তিক সংখ্যায় কবির বিখ্যাত ‘বিদ্রোহী’ কবিতা প্রকাশ পায়। মার্চে “ব্যথার দান” অক্টোবরে “অগ্নিবীণা” এভাবেই প্রকাশ হতে থাকে তাঁর অনবদ্য সৃষ্টিকর্ম। ৮ নভেম্বর রাজদ্রোহের অপরাধে গ্রেফতারী পরোয়ানা জারী হয় এবং ২৩ নভেম্বর তিনি গ্রেফতার হন। ১৯২৩ সালে “রাজবন্দীর জবান বন্দী” রচনা করেন। ২২ ফেব্রুয়ারি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর গীতিনাট্য “বসন্ত” নজরুলকে উৎসর্গ করেন। এতে নজরুল বেশ উল্লসিত হন এবং জেলে বসেই তিনি রচনা করেন “সৃষ্টি সুখের উল্লাসে” কবিতা। এভাবেই চলতে থাকে তাঁর অনবদ্য সৃষ্টিকর্ম। কবিতা, ছড়া, গল্প, উপন্যাস, গান, চলচ্চিত্র, নাটক, প্রবন্ধসহ বিবিধ কর্মজজ্ঞ।
কবি বেঁচেছিলেন বেশ অনেকটা বছর পর্যন্তই কিন্তু তাঁর সৃজনশীল কর্মকান্ড থেমে গিয়েছিল তার শারিরীক ও মানসিক অসুস্থতার কাছে। ১৯৪২ সালে কবি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। তারপর থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত তিনি বেঁচে ছিলেন জীবন্মৃতের মতো।
-লেখক : প্রভাষক (রাষ্ট্রবিজ্ঞান), সরকারি মুজিব কলেজ।