এম. সাইফুল ইসলাম শাফলু : ১৯৬৯ সাল। তখন দেশ স্বাধীনতা লাভ করেনি। সখীপুর থেকে ৫ কিলোমিটার দক্ষিণ পূর্বে নবগঠিত বহুরিয়া ইউনিয়নের কালিদাস বাজার ঘেঁষে সুশীতল বটবৃক্ষের ছায়ায় প্রাকৃতিক মনোমুগ্ধকর পরিবেশে গড়ে ওঠে কালিদাস কলিম উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয় । ওই গ্রামের সম্ভ্রান্ত মুসলিম ও ধনাঢ্য পরিবারের এক ক্ষণজন্মা মহান পুরুষ মো.কলিম উদ্দিন সিকদার। স্ব-শিক্ষিত হলেও তিনি তাঁর গ্রামকে উন্নত ও শিক্ষার মানকে অগ্রসর করতে ২ একর ৬০ শতাংশ জমির ওপর নিজ নামে ওই প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তুলেন। প্রতিষ্ঠানে তাঁর সঙ্গে আরও ১ একর ১৮ শতাংশ জমি দান করে মোকছেদ আলী মেম্বার চির স্মরণীয় হয়ে আছেন। মাত্র ৩০ জন শিক্ষার্থী নিয়ে শরু করলেও বর্তমানে ওই প্রতিষ্ঠানে ৪০৪ জন শিক্ষার্থী নিয়মিত অধ্যয়ন করছেন। এদের মধ্যে ২০০ জন ছাত্র এবং ২০২ জন ছাত্রী রয়েছে। বিদ্যালয় গড়ে তুলতে এ সময় সহযোগীতা করেন কালিদাস গ্রামের আবদুল কদ্দুস মাস্টার, মতিউর রহমান মাস্টার, দরবেশ আলী মেম্বার, আবদুল হালিম মিয়া, ইয়াকুব আলী মাতাব্বর, জমসের আলী মেম্বার, বক্তার আলী মেম্বার, তোফাজ্জল হোসেন, মোকছেদ আলী মেম্বার , আবদুল জলিল এবং গজারিয়া গ্রামের হায়দার আলী মাস্টার। ১ জানুয়ারি ১৯৭৩ সালে বিদ্যালয়টি নবম শ্রেণি খোলার অনুমতি পায় এবং ১৯৭৫ সালে ১২ জন পরিক্ষার্থী নিয়ে নিজ প্রতিষ্ঠানের নামে এসএসসি পরিক্ষা দেওয়া শুরু করে। এরপর থেকে প্রতিষ্ঠানটি মেধাবৃত্তি, জেএসসি এবং এসএসসি পরিক্ষায় সফলতার ধারা অব্যাহত রেখেছে। বিদ্যালয়ের সীমানায়ই কালিদাস সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং বন বিভাগের বীট কর্মকর্তার কার্যালয়। উপজেলা শহর থেকে বিদ্যালয়ে যাওয়ার প্রধান সড়কটি পাকা হওয়ায় পরিবেশে গত দিক থেকে অন্যসব প্রতিষ্ঠানের চেয়ে এটি আলাদা। শহরের ছোঁয়া সব সময় যেন লেগেই আছে। বুঝাই যায়না এটি গ্রামের প্রতিষ্ঠান। চারিদিকে সবুজ গাছপালা শস্য ফলাদি আর বটবৃক্ষের সুশীতল ছায়ায় মনটা জুরিয়ে যায়। বিদ্যুৎ ও জেনারেটর ব্যবস্থা ভাল থাকায় ডিজিটাল দেশ গড়ার লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠানে এরই মধ্যে শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব স্থাপন করা হয়েছে। কম্পিউটার শিক্ষক প্রতিটি ক্লাশের শিক্ষার্থীদের গ্রুপ ভেদে কম্পিউটার, ল্যাবটপ, ইন্টারনেটসহ অন্যান্য বিষয়ে দক্ষতার সাথে হাতে কলমে প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকেন। প্রতিদিন শিক্ষার্থীদের মাল্টিমিডিয়া ক্লাশ নেওয়া এবং এসেম্বলী ক্লাশ শেষে শিক্ষার্থীদের শ্রেণিকক্ষে পাঠদান শুরু করা এ প্রতিষ্ঠানের দৈনন্দিন সূচি। প্রতিষ্ঠার পর থেকে যারা সৎ ও নিষ্ঠার সঙ্গে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন তারা হলেন মো. মোজাম্মেল হোসেন (বিকম), মো.আবদুল হাই এমএসসি (ভারপ্রাপ্ত হিসেবে), মো. আবদুর রহমান (বিএ), মো. নূরুল ইসলাম খান ফনি (বিএবিএড), মো. আবদুল বারী (বিএবিএড), মোজাম্মেল হক বিএ (ভারপ্রাপ্ত হিসেবে), মো. আজগর আলী (বিএবিএড), আহাম্মদ হোসেন বিএবিএড (ভারপ্রাপ্ত হিসেবে), একেএম সাইফুল্লাহ বিএবিএড (ভারপ্রাপ্ত হিসেবে) এবং ৮ জানুয়ারি ২০১৪ সাল থেকে সফলতার সঙ্গে মো. হোসেন আলী আজবধি প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। প্রতিষ্ঠানে যারা সভাপতি হিসেবে গুরু দায়িত্ব পালন করেছেন তাদের মধ্যে কালিদাস পূর্বপাড়া গ্রামের মো. আবদুল কদ্দুস মাস্টার, গাজারিয়া গ্রামের মো. হায়দার আলী মাস্টার, কালিদাস মধ্যপাড়ার মো. মতিউর রহমান মাস্টার, কালিদাস মধ্যপাড়ার মো. সাখাওয়াত হোসেন, কালিদাস বাজার এলাকার মো. শাসসুল আলম , কালিদাস পূর্বপাড়ার মো. আনোয়ার হোসেন, কালিদাস গ্রামের আরেক শিক্ষানুরাগী বাংলাদেশ সরকারের সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব মো. খলিলুর রহমান সভাপতির হাল ধরেন। তাঁর সময়ে প্রতিষ্ঠানের বেশ কিছু উন্নয়ন মূলক কাজ হয় যেমন, মাঠ ভরাট, নতুন ভবন নির্মাণ, পুরাতন ভবনের সংস্কার এবং দখল হয়ে যাওয়া বিদ্যালয়ের বেশ কিছু
জমি দখলমুক্ত করা হয়। এর পর ওই বিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান শিক্ষক মো. আজগর আলী মিয়া সভাপতির দায়িত্ব নেন। বর্তমানে ব্রাকের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. জাহাঙ্গীর আলম বুলবুল সভাপতির দায়িত্ব নেন। তিনি সততার সঙ্গে নিয়মিত বিদ্যালয়ের সর্বদিক দেখবাল করে থাকেন। সার্বক্ষণিক বিদ্যুৎ ব্যবস্থা রাখতে তিনি প্রতিষ্ঠানে নিজ উদ্যোগে জেনারেটর ব্যবস্থা করেছেন। বিদ্যালয় থেকে পাঠদান শেষে যে সকল শিক্ষার্থী দেশের বিভিন্ন সেক্টরে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছেন তাদের মধ্যে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর ইউংকমা-ার হিসেবে মো. আবু রায়হান, ভেটেনারী চিকিৎসক হিসেবে মো. সাইফুল ইসলাম, পূবালী ব্যাংকের কর্মকর্তা হিসেবে মো. মাহফুজুর রহমান, সিইওপি হিসেবে মো. তোফায়েল আহমেদ, প্রকৌশলী সাইফুল ইসলাম, কলেজ অধ্যাপনায় মো. ছানোয়ার হোসেন, মো. ওয়াজেদ আলী, মো. সাইফুল আলম , সাইফুল ইসলাস এবং চিকিৎসক হিসেবে দিপঙ্কর সরকার, সিইও ট্রাস্ট ইন্টারন্যাশনালের চেয়ারম্যান হিসেবে মো. সাইফুল ইসলাম শরীফ উল্যেখযোগ্য। বিদ্যালয়ে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীসহ ১৫ জন শিক্ষক কর্মচারী কর্মরত আছেন। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. হোসেন আলী জাতীয় শিক্ষা সপ্তাহ ২০১৬ উপলক্ষে ইউনিয়ন সেরা শিক্ষক নির্বাচিত হন। এছাড়াও বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক একেএম সাইফুল্লাহ উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতির নির্বাচনে দপ্তর সম্পাদক হিসেবে সাত বছর, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হিসেবে তিন বছর এবং সাধারণ সম্পাদক হিসেবে তিন বছর দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৬ এর নির্বাচনে তিনি পূণরায় ওই সমিতির সাধারণ সম্পাদক হিসেবে নির্বাচিত হন। অপর এক সহকারী শিক্ষক (শারীরিক) মো. ইব্রাহিম হোসেন উপজেলা শারীরিক শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক হিসেবে চার বছর ধরে দায়িত্ব পালন করছেন। ২০১১ সাল থেকে ওই বিদ্যালয়কে বহুরিয়া ইউনিয়নের পিইসি পরিক্ষা সেন্টার এবং আন্ত:স্কুল মাদরাসার ক্রীড়া প্রতিযোগীতার ভেনু করা হয়। নিয়মত্রান্ত্রিকতার সাথে প্রতিবছর বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবস, শোক দিবসসহ সকল ধরনের কর্মকা-ে অংশ নিয়ে থাকেন ওই প্রতিষ্ঠান। ২০১৫ সালে আন্ত:স্কুল মাদরাসা ফুটবল প্রতিযোগীতায় বিদ্যালয়টি ইউনিয়ন চ্যাম্পিয়নের শিরোপা ভয়ে আনে। বিদ্যালয় থেকে ২০১৫ সালে জেএসসিতে ৭৩ জন পরীক্ষায় অংশ নিলে শতভাগ পাশ করে। এতে এ প্লাস পায় ১৭ জন, এ ৩৬ জন, এ মাইনাস ১৪ জন, বি ৪ জন এবং সি পায় ৫ জন। এ বছর এসএসসিতে ৩৫ জন পরীক্ষার্থী অংশ নেয় । পাশ করে ৩৪ জন। এদের মধ্যে এ প্লাস পায় ১ জন, এ পায় ২১ জন, এ মাইনাস ৯ জন এবং বি পায় ৩ জন। পাসের হার ৯৭.১৪ ভাগ। সামনে ৮০ জন জেএসসি পরিক্ষার্থী পরিক্ষায় অংশ নেবে। ভাল ফলাফলের দিকে নজর দিয়ে ওইসব শিক্ষার্থীদের অতিরিক্ত ক্লাশ নেওয়া হয়। এছাড়া প্রতিষ্ঠানকে আরও এগিয়ে নিতে অষ্টম ও দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের সন্ধ্যা ৬ টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত নিয়মিত নাইট ক্লাশ নেওয়া হয়। প্রত্যেক শিক্ষার্থীর অভিভাবক বসে থেকে তাদের নিজ নিজ সন্তানদের ক্লাশ শেষে বাড়ি নিয়ে যান। এখানে লেখাপড়ার পাশাপাশি গান, গজল নাটক, কবিতা আবৃত্তিসহ নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের উৎসাহ উদ্দীপনাকে আরও বাড়িয়ে দেওয়া হয়। পরিশেষে বলা যায় এ প্রতিষ্ঠানটি উপজেলার হাতেগোনা কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে মাদক, বাল্যবিয়ে এবং রাজনীতি মুক্ত একটি অন্যতম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।
প্রধান শিক্ষক মো. হোসেন আলী বিদ্যালয়ের বেশ কিছু সমস্যার কথা তুলে ধরে বলেন, পুরাতন পাকা ভবনের দ্রুত সংস্কার এবং নতুন দ্বিতল ভবনের একান্ত প্রয়োজন। কাঁদাযুক্ত নিচু খেলার মাঠ ভরাট করে উঁচু করা এবং টিনসেট ভবনগুলোর কাঁচা মেঝে পাঁকা করা প্রয়োজন।