সাইফুল ইসলাম সানি:
সখীপুরে শীতের প্রথম দিক থেকেই শুরু হয় বাউলগানের আসর। প্রায় প্রতি রাতেই পাঁচ থেকে সাত স্থানে বাৎসরিক ওরশ মাহফিলে বাউলগানের আয়োজন করা হয়। বাউল সম্প্রদায়ের নিজস্ব এসব সাধনগীতকে স্থানীয়ভাবে ভাবসঙ্গীতও বলা হয়। বাউলগানে আবহমান বাংলার প্রকৃতি, মাটি ও মানুষের জীবন জিজ্ঞাসা একাত্মা হয়ে ফুটে উঠে। ফুটে ওঠে সাম্য ও মানবতার বাণী। এ কারণে প্রতিটি আসরেই নানা শ্রেণিপেশার হাজার হাজার গানপ্রেমীর সমাগম ঘটে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, বাউল গান মূলত বাউল সম্প্রদায়েরর গান। যা বাংলা লোকসাহিত্যের একটি বিশেষ অংশ। সখীপুরে সাধারণত পীর মুরশীদের ভক্ত আশেকানরা তাদের বাৎসরিক ওরশ মাহফিলে প্রতি বছর একটি নির্দিষ্ট দিনে নিজনিজ বাড়িতে এসব গানের আয়োজন করেন। বাউলরা জারি, সারি ও পালাগানের মাধ্যমে তাদের দর্শন ও মতামত প্রকাশ করেন। সখীপুরসহ বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলে সাধারণত পালাগানের জনপ্রিয়তা বেশি। পালাগানের মধ্যে রয়েছে- নারী-পুরুষ, দেবর-ভাবী, ননদ-ভাবী, শরীয়ত-মারেফত, গুরু-শিষ্য, বউ-শাশুরী, নবুয়ত-বেলায়েত, নবীর জীবনী ও মেরাজ, হাশর-কিয়ামত, জীব ও পরম, হিন্দু-মুসলিম ইত্যাদি। পালাগানের আসরে দু’জন শিল্পীকে দু’টি বিষয় ভাগ করে দেয়া হয়। শিল্পীরা প্রাসঙ্গিক গানের মাধ্যমে ওই নির্দিষ্ট বিষয়ের ওপর প্রতিপক্ষকে বিভিন্ন প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে গান শেষ করেন। প্রতিপক্ষও গানের মাধ্যমে প্রশ্নের উত্তর দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করে গান শেষ করেন। এভাবেই রাতব্যাপী চলে গানের আসর। পালাগান ছাড়াও এ অঞ্চলের কোনো কোনো আসরে লালনগীতি, কবিগান, দেশের গান, বিজয় বিচ্ছেদ, জালালগীতি ও হিন্দুদের লালা বাবুর মামলা গানেরও প্রচলন রয়েছে।
উপজেলার প্রতিমা বংকী গ্রামের বাউলগান প্রেমী সাবেক ইউপি সদস্য জিন্নাত আলী জানান, এ অঞ্চলে বিভিন্ন পালাগানের প্রচলন থাকলেও সাধারণত ‘গুরু-ভক্ত’ পালা গানটি বেশি জনপ্রিয়। গুরু শিষ্যের আসরে গান শুনতে শুনতে একপর্যায়ে গুরুর কথা স্বরণ করে আবেগে আপ্লুত হয়ে ভক্তরা কান্নায় ভেঙে পড়েন।
এ অঞ্চলে প্রতি শীত মৌসুমে প্রায় পাঁচ শতাধিক স্থানে বাউল গানের আসর বসে। এদের মধ্যে উপজেলার লাঙ্গুলিয়া গ্রামের কেফাতুল্লাহ চেয়ারম্যান বাড়ি, পৌর শহরের রফিক কাউন্সিলরের বাড়ি, জিয়ারত আলী পীর, ছামান পাগলার মেলা, ফয়েজ পীর, কচুয়া হানিফ পীর, বড়চওনায় আল-আমিন সরকার, ভুয়াইদ কুটুম পাগলার মেলা, গড়গোবিন্দপুরের সবুর পীর, লাঙ্গুলিয়ার আমজাদ পীর, কালিদাসের দয়াল শফীর বাড়ি, চতলবাইদ মোশারফ পীর, নলুয়ার প্রয়াত শরবেশ খাঁনের বাড়িতে বাৎসরিক ওরশ মাহফিলের বাউল গানের আসর উল্লেখযোগ্য।
এসব গানের আসরে দেশবরেণ্য বাউল শিল্পীরা গান পরিবেশন করেন। সখীপুরে সাধারণত বিখ্যাত বাউল শিল্পী কাজল দেওয়ান, লালন সাধক শফি মন্ডল, ময়মনসিংহের সুনীল বাবু, লতিফ সরকার, আরিফ দেওয়ান, মোতালেব সরকার, ছোট আবুল, বড় আবুল, সমির বাউল, আবির বাউল, মুক্তা সরকার, শিউলী দেওয়ান, স্বপ্না রাণী সরকার, শোলাপ্রতিমার মজিদ সরকার, হানিফ সরকার, জালাল সরকারসহ আরো প্রায় শতাধিক বাউল শিল্পী নিয়মিত গান পরিবেশন করেন। গানপ্রেমীরা প্রতিটি ওরশের দিন তারিখ মনে রেখে যথাসময়ে উপস্থিত হন। বাউল গানের আসরে বসে ক্ষনিকের জন্যে হলেও অন্য এক জগতের বাসিন্দা হয়ে যান ভক্তরা। ভক্তদের ভাষায় এ জগত ভাবের জগত; ভাবের দেশ।
বাউল গান সম্পর্কে জানতে চাইলে বঙ্গের আলীগড় খ্যাত টাঙ্গাইলের সরকারি সা’দত বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের অধ্যক্ষ গীতিকার, সুরকার ও চর্যা গবেষক প্রফেসর আলীম মাহমুদ একান্ত সাক্ষাতকারে বাংলাদেশের খবরকে বলেন, ‘বাংলা সাহিত্যের সঙ্গে বাউল গানের যোগসূত্র রয়েছে। আমাদের সাহিত্যের যে তিনটি ভাগ রয়েছে- প্রাচীন পর্ব, মধ্যম পর্ব ও আধুনিক পর্ব। এ মধ্যযুগের সাহিত্য ধারার শুরু থেকেই বাউল গানের প্রচলন শুরু হয়। বাউলদের মধ্যেও বিভিন্ন মতবাদ লক্ষ্য করা যায়। দেহত্ববাদী, মারেফতি ও শরীয়তি। এসব সমন্বয় করে বাউল গানের প্রবক্তাদের মধ্যে লালন শাহ্, পাঞ্জু শাহ্, সিরাজ শাহ্ এবং দুদ্দু শাহ্ বহু বাউল সঙ্গীত রচনা করেছেন। হিন্দুদের মধ্যে বিজয় সরকারসহ অন্যরা। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের সঙ্গেও বাউল গানের সম্পর্ক দৃশ্যমান। কারণ রবীন্দ্রনাথও বাউলদের আত্মদর্শন আত্মস্থ করেছিলেন। তাঁর অনেকগুলো সুরের ধারা বাউল গানের সুরের সঙ্গে মিলে যায়। আমাদের জাতীয় সঙ্গীতের সুরও রবীন্দ্রনাথ বাউলদের কাছ থেকে নিয়েছিলেন। বৃহত্তর ময়মনসিংহের টাঙ্গাইলে যে পালাগান, বিচ্ছেদ গান হয় এগুলো বাউলগানেরই একটি অংশ।’
জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক সংস্থা ইউনেসকো বাংলার বাউল গানকে বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। ইউনেসকো ২০০৫ সালের ২৭ নভেম্বর বাউল গানকে ‘ইনট্যানজিবল কালচারাল হেরিটেজ’-এর তালিকাভুক্ত করে। এ সময় বিশ্বের ৪৩টি বাক ও বিমূর্ত ঐতিহ্য চিহ্নিত করতে গিয়ে বাংলাদেশের বাউল গানকে বিশ্ব সভ্যতার সম্পদ ও অসাধারণ সৃষ্টি বলে আখ্যা দেয়া হয়। বাউল গানে আবহমান বাংলার প্রকৃতি, সাম্য ও মানবতার বাণী, মাটি আর মানুষের জীবন জিজ্ঞাসা একাত্মা হয়ে ফুটে ওঠে।
বাউল গবেষক ও ভক্তদের মতে, বর্তমানে প্রকৃত বাউল খোঁজে পাওয়া কঠিন। প্রকৃতপক্ষে নিজ দেহের মধ্যে সৃষ্টিকর্তাকে পাওয়ার তীব্র ব্যাকুলতা থেকে বাউল ধারার সৃষ্টি। বাউল সাধকদের সাধনার মাধ্যম হচ্ছে গান। প্রত্যেক মানুষের অন্তরে যে পরমের উপস্থিতি, সেই অদেখাকে দেখা আর অধরাকে ধরাই বাউল সাধন-ভজনের উদ্দেশ্য। বাউলের ভূখন্ড তাঁর দেহ, পথপ্রদর্শক তাঁর গুরু, জীবনসঙ্গী নারী, সাধনপথ বলতে সুর, আর মন্ত্র বলতে একতারা। ভিক্ষা করেই প্রকৃত বাউলের জীবনযাপন। ভিক্ষা না পেলেও তাঁর দুঃখ নেই। তাঁর যত দুঃখ মনের মানুষকে না পাওয়ার। বাউলের সাধনপথ যত দীর্ঘায়িত হয়, ব্যাকুলতা ততো বাড়ে। দুঃখ যত গভীর হয়, গান হয় ততো মানবিক।
–লেখক: সাংবাদিক, বাংলাদেশের খবর
বার্তা সম্পাদক, সাপ্তাহিক সখীপুর বার্তা