আলীম মাহমুদ জুনিয়র : “খুব জানতে ইচ্ছে করে, তুমি কি সেই আগের মতোই আছো” আজ মরমী কণ্ঠশিল্পী মান্না দে’র জন্মদিনে তাঁর এই গানের মতোই বারবার জানতে ইচ্ছে করছে কেমন আছেন আমাদের দেশের মেহনতি মানুষেরা? কেমন আছেন শ্রমিকরা, আর কেমন আছেন সেই সব মানুষেরা- যাঁদের শ্রমে ঘামে গড়ে উঠছে সোনার বাংলা। যাঁর শ্রম দিয়ে যাচ্ছেন নিরন্তর- পাচ্ছেন না তাঁদের ন্যায্য অধিকার, পাচ্ছেন না শ্রমের ন্যায্য মজুরি। অথচ তাঁরা একদিন শ্রম বিক্রি বন্ধ রাখলে হাজারো বিলাসীর বিলাসিতা বন্ধ হবার উপক্রম হবে। বন্ধ হবে ভোগ-বিলাসিতা। শ্রমিকের ঘামের সাগরে চালায় বিলাসীর বিলাসবহুল জাহাজ। সেই শ্রমিকদের অধিকার আদায় ও দৈনিক ৮ ঘন্টা কাজের দাবী আদায়ই মে দিবসের মূল প্রতিপাদ্য।
০১ মে। আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস, যা সচরাচর মে দিবস নামে বিশ্বব্যাপী পালিত হয়। আন্তর্জাতিক শ্রমিক আন্দোলন দিবস হিসেবেও উদযাপিত হয় এদিন। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে শ্রমজীবী মানুষ এবং শ্রমিক সংগঠন সমূহ রাজপথে সংগঠিত ভাবে মিছিল এবং শোভাযাত্রার মাধ্যমে দিবসটি পালন করে। বাংলাদেশসহ বিশ্বের প্রায় ৮০টি দেশে ১ মে সরকারি ছুটির দিন। ১৯৮৬ সালে আমেরিকার শিকাগো শহরের হে মার্কেটের ম্যাসাকার শহীদদের আত্মত্যাগকে স্মরণ করে পালিত হয় এই দিবস। সেদিন আট ঘন্টার কাজের দাবীতে শ্রমিকরা হে মার্কেটে জমায়েত হয়েছিল। তাদেরকে ঘিরে থাকা পুলিশের প্রতি এক অজ্ঞাতনামার বোমা নিক্ষেপের পর পুলিশ শ্রমিকদের উপর গুলিবর্ষণ শুরু করে। ফলে প্রায় ১০-১২ জন শ্রমিক ও পুলিশ নিহত হয়। ১৮৮৯ সালে ফরাসী বিপ্লবের শতবার্ষিকীতে প্যারিসে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক-এর প্রথম কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে ১৮৯০ সাল থেকে শিকাগে প্রতিবাদের বার্ষিকী আন্তর্জাতিকভাবে বিভিন্ন দেশে পালনের প্রস্তাব করেন রেমন্ড লাভিনে। ১৮৯১ সালের আন্তর্জাতিকের দ্বিতীয় কংগ্রেস এই প্রস্তাব আনুষ্ঠানিকভাবে গৃহীত হয়। এর পরপরই মে দিবসের দাঙ্গার ঘটনা ঘটে। পরে, ১৯০৪ সালে আমস্টারডাম শহরে অনুষ্ঠিত সমাজতন্ত্রীদের আন্তর্জাতিক সম্মেলনে এই উপলক্ষে একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়। প্রস্তাবে দৈনিক আট ঘন্টা কাজের সময় নির্ধারণের দাবি আদায়ের জন্য এবং শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য বিশ্বজুড়ে ১ মে তারিখে মিছিল ও শোভাযাত্রাআয়োজনের সকল সমাজবাদী গণতান্ত্রিক দল এবং শ্রমিক সংঘের প্রতি আহ্বান জানানো হয়।
সেই সম্মেলনে “শ্রমিকদের হতাহতের সম্ভাবনা না থাকলে বিশ্বজুড়ে সকল শ্রমিক সংগঠন মে’র ১ তারিখে বাধ্যতামূলকভাবে কাজ না করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। অনেক দেশে শ্রমজীবী জনতা মে মাসের ১ তারিখে সরকারি ছুটির দিন হিসেবে পালনের দাবি জানায়। অনেক দেশে এটি কার্যকরও হয়। দীর্ঘদিন ধরে সমাজতান্ত্রিক, কমিউনিষ্ট এবং কিছু কট্টর সংগঠন তাদের দাবী জানানোর জন্য মে দিবসকে মুখ্য দিন হিসেবে বেছে নেয়। কোন কোন স্থানে শিকাগোর হে মার্কেটের আত্মত্যাগী শ্রমিকদের স্মরণে আগুনও জ্বালানো হয়। পূর্বতন সোভিয়েত ইউনিয়ন, চীন, কিউবাসহ বিশ্বের অনেক দেশেই মে দিবস একটি তাৎপর্যপূর্ণ দিন। বাংলাদেশে এবং ভারতেও দিবসটি যথাযথ তাৎপর্যের সাথে পালিত হয়। ভারতবর্ষে প্রথম মে দিবস পালিত হয় ১৯২৩ সালে।
পালিত হয় মে দিবস। পালিত হয় শ্রমিক দিবস। অধিকার আদয়ের দিবস। বন্ধ রাখা হয় শ্রমিকের কাজ। কিন্তু কাজের কাজ কিছু কি হয়? হয় কি শ্রমিকের অধিকার আদায়? পায় কি ন্যায্য মজুরি? শ্রমিকের শ্রম ঠিকই হচ্ছে, তেমনি হচ্ছে বিলাসীর বিলাসিতা। কখনও কি হয়েছে শ্রমিকরে বিলাসিতা, বিলাসীর শ্রম? যত দিবস আর আন্দোলনই হোক না কেন সবশেষে একটাই প্রতিপাদ্য শ্রমিকের শ্রম : বিলাসীর বিলাসিতা।
-লেখক : প্রভাষক (রাষ্ট্রবিজ্ঞান), সরকারি মুজিব কলেজ। নির্বাহী সম্পাদক, সাপ্তাহিক‘সখীপুর বার্তা’।