17 C
Dhaka
Thursday, January 23, 2025

সখীপুর আবাসিক মহিলা কলেজে ইংরেজি বিতর্ক প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত

জাহিদ হাসান: টাঙ্গাইলের সখীপুর উপজেলার একমাত্র নারী...

সখীপুরে ব্যবসায়ীর গলা কাটা লাশ উদ্ধার

জাহিদ হাসান: টাঙ্গাইলের সখীপুরে আব্দুস সালাম (৪৮)...

লাবীব গ্রুপে এসএসসি ও এইচএসসি পাশে নিয়োগ, সখীপুরবাসীর অগ্রাধিকার

নিজস্ব প্রতিবেদক: লাবীব গ্রুপের সিস্টার কনসার্ন Excel...

একজন গুণী শিক্ষিকার ভাষাপ্রেম

জাতীয়একজন গুণী শিক্ষিকার ভাষাপ্রেম

আলমগীর ফেরদৌস: সখীপুর থানা সদর হতে প্রায় ৩ কিলোমিটার দূরত্ব। যোগাযোগ ব্যবস্থা এখন উন্নত হলেও কয়েক বছর আগে তা সহজ ছিলোনা। উপজেলার প্রতিমা বংকী গ্রামের মাস্টার পাড়ায় একটি মাত্র সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। থানা সদর হতে দূরত্ব ও অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে স্কুলের শিক্ষার্থীরা ২১ ফেব্রুয়ারির প্রভাত ফেরিতে অংশগ্রহণ করতে পারেনা। ২০০৮ সালে ইউনেস্কো কর্তৃক ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণার পর হতে ভাষা শহীদদের স্মরণ করার জন্য কলাগাছ, বাঁশ, রঙ্গিণ কাগজ দিয়ে অস্থায়ী শহীদ মিনার তৈরি করার প্রথম উদ্যোগ গ্রহণ করেন ওই বিদ্যালয়েরই একজন সহকারী শিক্ষিকা। তারপর প্রতি বছরই শিক্ষার্থীদের নিয়ে অস্থায়ী শহীদ মিনার নির্মাণ করে আসছেন তিনি। গ্রামের বিভিন্ন বাড়ি বাড়ি গিয়ে ফুল সংগ্রহ করেন। ফুলের তোড়া তৈরী করেন। শিশির ভেজা একুশের প্রভাতে গ্রামের মেঠোপথ ধরে সকল শিক্ষক-শিক্ষার্থী গভীর শ্রদ্ধায় বিদ্যালয় মাঠে উপস্থিত হন। তাদের হাতে একটি দুটি করে ফুল তুলে দেন। উপস্থিত সকলে সমস্বরে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কী ভুলিতে পারি…’ গান গাইতে গাইতে বিদ্যালয় মাঠ প্রদক্ষিণ করেন। অস্থায়ী শহীদ মিনারেই গভীর শ্রদ্ধা মমতা আর ভালোবাসায় পুস্পস্তবক অর্পণ করা হয়। ভাষাপ্রেমী এই গুণী শিক্ষিকা প্রতিমা বংকী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষিকা বেগম আলেয়া ফেরদৌসী। তিনি সখীপুর পিএম পাইলট স্কুল এন্ড কলেজের সাবেক প্রধান শিক্ষক এসএম আজহারুল ইসলামের স্ত্রী।


প্রতি বছর শিক্ষার্থীদের নিয়ে অস্থায়ী শহীদ মিনার তৈরীর সময় ’৫২ -এর ভাষা আন্দোলনের দিনগুলোর কথা আলোচনা করেন। পশ্চিম পাকিস্তানের উর্দূ ভাষাকে কিভাবে এ দেশের মার্তৃভাষা হিসাবে চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল, কার্জন হলে জিন্নার ভাষণ, ছাত্রদের আন্দোলন, ১৪৪ ধারা জারী, অন্যায়ের প্রতিবাদ, মাতৃভাষা বাংলার দাবীতে ঢাকায় ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করা, ঢাকার রাজপথ মিছিলে মিছিলে প্রকম্পিত, মিছিলের উপর পুলিশের গুলি বর্ষণ, রাজপথে লুটিয়ে পড়ে ভাষা শহীদের লাশ, সালাম রফিক বরকতের বুকের তাজা রক্তে রাজপথ ভেসে যাওয়র ইতিহাস বর্ণনা করেন শিক্ষার্থীদের সঙ্গে। এসব কথা বলতে বলতেই শেষ হয় অস্থায়ী শহিদ মিনার নির্মাণের কাজ। এসময় শিক্ষার্থীরা তাদের প্রিয় শিক্ষিকার কাছে দাবি করে- স্কুলে একটি স্থায়ী শহীদ মিনার থাকলে ভালো হয়। সবাই ভাষা আন্দোলন ও মাতৃভাষার গুরুত্ব সম্পর্কে জানতে পারতো। কিন্তুু প্রত্যন্ত অঞ্চলের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শহীদ মিনার নির্মাণের কোন প্রকল্প না থাকায় তা আর বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়না। তবুও থেমে থাকেননি তিনি। চলতি বছরের একুশের প্রভাত ফেরী শেষ করে উপস্থিত ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গে তাদের প্রিয় ম্যাডাম আলেয়া ফেরদৌসী ওয়াদা করেন আগামী বছর আমরাএখানে একটি স্থায়ী শহীদ মিনার তৈরী করব। সামনের একুশের প্রভাত ফেরী শেষে আমরা ইট-পাথরের তৈরী স্থায়ী শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করব ইনশা-আল্লাহ। কোমলমতী শিক্ষার্থীদের আনন্দ যেনো আর ধরেনা! তারপরও শিক্ষার্থীদের মনে প্রশ্ন- ম্যাডাম কিভাবে শহীদ মিনার তৈরী করবেন? শুনেছি অনেক টাকা লাগে। ম্যাডাম এতো টাকা কোথায় পাবেন? স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির সভায় সহকারী শিক্ষিকা আলেয়া ফেরদৌসী খেলার মাঠের পাশে এক শতাংশ খালি জমিতে শহীদ মিনার নির্মাণের অনুমতি চাইলেন। কমিটির পক্ষ হতে সদয় অনুমোদন দেয়া হলো। স্কুল ভবনের পাশে খালি জায়গায় শহীদ মিনার নির্মাণের জন্য স্থান নির্ধারণ করা হলো। ম্যানেজিং কমিটিরও সংশয়, কিভাবে তিনি শহীদ মিনার তৈরী করবেন! টাকা কোথায় পাবেন?

 সবাইকে অবাক করে দিয়ে তিনি বললেন, তার সঞ্চিত টাকা দিয়ে একটি শহীদ মিনার নির্মাণ করে তার অনেক দিনের স্বপ্ন পূরণ করতে চান। ভাষা শহীদ সালাম, রফিক ও বরকতের মায়েদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করতে চান। তখনো বিষটি তেমন গুরুত্ব দেয়া হলোনা। কিন্তু তার কয়েকদিন পর এক বিকেলে একটি ইট ভর্তি ট্রাক স্কুলমাঠে এসে হাজির হলো। পরের দিন সকালে সবাইকে অবাক করে দিয়ে একটি বালির ট্রাক উপস্থিত। সেদিন বিকেলেই ছয়-সাতজন নির্মাণ শ্রমিক একটি শহীদ মিনারের নকশা নিয়ে নির্দিষ্ট জায়গায় মাপযোগ শুরু করলে সবাই বিশ^াস করতে শুরু করলো, সত্যি সত্যিই স্কুলে শহীদ মিনার নির্মাণ হচ্ছে। আশপাশের মুরুব্বিরা এসে শহীদ মিনার নির্মাণের কাজ দেখেন। স্কুলের শিক্ষার্থীরা ক্লাস শেষ করে বিকেলে এসে নির্মাণ শ্রমিকদের সঙ্গে গল্প করে। এটা ওটা এগিয়ে দেয়। একে অপরের সঙ্গে গল্প করে- ‘মাঝখানে যে পিলার এটা হইলো সালাম রফিক ও বরকতের মা। দুইপাশের পিলারগুলো হইলো মায়ের আদরের ছেলে; যারা পুলিশের গুলিতে শহীদ হয়েছেন। আর মাঝখানে একটা বৃত্ত আঁকা হবে; যার রঙ হবে টুকটুকে রক্তের মত। এই লাল রঙ হলো ভাষার জন্য যারা প্রাণ দিয়েছে, তাঁদের বুকের রক্তের চিহ্ন।’ এভাবেই ধীরে ধীরে প্রচলিত নকশা অনুসারে ছোট পরিসরে একটি শহীদ মিনার তৈরী হলো। একজন প্রাথমিক স্কুল শিক্ষিকা তাঁর সঞ্চিত টাকায় অনেক দিনের লালিত স্বপ্ন পূরণ করলেন। স্কুলের ছোট ছোট বাচ্চাদের স্বপ্ন পূরণ করে দিলেন। শরতের ধবধবে সাদা কাঁশফুলের মতো মা তাঁর দুইপাশে ভালোবাসার ছেলেদের নিয়ে বুকে টকটকে তাজা রক্তের বৃত্ত এঁকে স্কুলের পাশে সবুজ মাঠের এক কোণে ভাষা শহীদদের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। স্কুল মাঠের পাশে দাঁড়িয়ে আছে একটি শহীদ মিনার। দাড়িয়ে আছে একটি ওয়াদার বাস্তবায়ন, দাড়িয়ে আছে ভাষাপ্রেমী এক মায়ের স্বপ্ন। আগামী একুশের প্রভাত ফেরিতে এলাকার সকল শ্রেণি-পেশার মানুষ, স্কুলের ছাত্র-ছাত্রী ও শিক্ষক মন্ডলী পরম মমতায় ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে পারবে। শহীদ মিনার নির্মাণ খরচের টাকা আম্মাকে দেয়ার জন্য বারবার চেষ্টা করেছি। অনুরোধ করেছি। কিন্তুু তিনি তা গ্রহণ করেননি। কোথাও তার নামও উল্লেখ করেননি। শুধু শহীদ মিনারের বেদির নিচে মার্বেল পাথরে খোদাই করে লিখে দিয়েছেন ‘শহীদ মিনার নির্মাণ উদ্যোগ ও বাস্তবায়ন- ‘আজহার ফাউন্ডেশন’। শহীদ মিনার নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ এবং বাস্তবায়নের জন্য প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষকমন্ডলী, আজহার ফাউন্ডেশন ও এলাকার সকলের পক্ষ হতে আপনাকে জানাই পরম শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। অপনার কাছে আমরা সবাই ঋণী হয়ে রইলাম। আপনার এ ভাষাপ্রেম যুগযুগ ধরে পরবর্তী প্রজন্মকে মাতৃভাষার প্রতি শ্রদ্ধাশীল করবে। এই প্রত্যাশা নিরন্তর…।

লেখক- আইনজীবী  ও ম্যানেজিং ডিরেক্টর, ছুটি রিসোর্ট লিমিটেড।

Check out our other content

Check out other tags:

Most Popular Articles