মামুন হায়দার:
সখীপুর পৌরসভার পয়ঃ ও কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনার লক্ষে ২০১৫ সালে স্থানীয় সরকারের উদ্যোগে এবং ওয়াটার এইডের আর্থিক ও কারিগরি সহায়তায় ২৫ শতাংশ জমির উপর স্থাপিত হয় সখীপুর কো-কম্পোষ্ট প্লান্ট। প্রাথমিকভাবে ছোট আকারে শুরু হলেও গত তিন বছরে এখন এটি সখীপুর উপজেলার প্রায় অর্ধেক মানুষকে এই সুবিধার আওতায় নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছে। এই ব্যবস্থায় স্বল্প মূল্যে বাসাবাড়ি ও প্রতিষ্ঠান থেকে পয়ঃবজ্য ও কঠিন বর্জ্য যেমন: গৃহস্থালির পচনশীল ও অপচনশীল আবর্জনা সংগ্রহ করে তা থেকে প্রস্তুত করা হয় কৃষি জমিতে ব্যাবহারযোগ্য জৈব সার।
বর্জ্য ব্যবস্থাপনার উদ্দেশ্যে স্থাপিত কো-কম্পোস্ট প্ল্যান্টের তিন বর্ষপূর্তি উপলক্ষে গত ১৯ জানুয়ারি আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. সুলতান আহমেদ এবং বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ওয়াটার এইড বাংলাদেশের ডিরেক্টর প্রোগ্রাম পলিসি এন্ড এডভোকেসি ড. লিয়াকাত আলী। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন সখীপুর পৌরসভার মেয়র আবু হানিফ আজাদ। এছাড়াও আরও উপস্থিত ছিলেন সখীপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আমিনুর রহমান, ওয়াটার এইডের ডিরেক্টর পলিসি এন্ড এডভোকেসি ড. আবদুল্লাহ আল মুয়ীদ, প্রকল্প পরিচালক সুমন কান্তি নাথ, পরিবেশ অধিদপ্তর টাঙ্গাইল জোনের উপ- পরিচালক মুজাহিদুল ইসলাম, স্থানীয় এনজিও ‘বাসা’-এর ইডি একেএম সিরাজুল ইসলামসহ স্থানীয় সরকারী ও বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাবৃন্দ।
আয়োজিত এই অনুষ্ঠান সকাল ১০টায় পৌরসভার সম্মেলনকক্ষে ‘পরিবেশ রক্ষায় গত তিন বছরে কো-কম্পোস্ট প্ল্যান্টের অগ্রগতির উপর আলোচনা’ এর মাধ্যমে শুরু হয়। এরপর স্থানীয় উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান ‘মেসার্স জোয়া এন্টারপ্রাইজ’ এর সাথে ব্যাবসায়িকভাবে এই কো-কম্পোস্ট প্ল্যান্টের পরিচালনা চুক্তি স্বাক্ষর হয় এবং দুপুরে সম্মিলিতভাবে প্ল্যান্ট পরিদর্শনের মাধ্যমে শেষ হয়। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তার বক্তব্যে পয়ঃবর্জ্য ব্যবস্থাপনার গুরুত্ব তুলে ধরেন এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনার এই কো-কম্পোস্টিং পদ্ধতির প্রশংসা করেন। তিনি বলেন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় সখীপুরকে মডেল ঘোষণা করে পৌরসভাকে এইরকম উদ্যোগ নেওয়ায় ধন্যকাদ জানান। এছাড়াও তিনি সখীপুর পৌরসভার অবকাঠামোগত উন্নয়ন, পরিবেশ ও গাছ রক্ষায় বিশেষ নজরদানের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করেন। বিশেষ অতিথি ড. লিয়াকাত আলী তার বক্তব্যে পয়ঃবর্জ্য থেকে স্বাস্থ্যঝুকি, এবং বর্জ্যকে ব্যাবহার করে সার উৎপাদন ও তাকে কৃষি জমিতে ব্যাহারের এই পদ্ধতিকে কিভাবে আরও উন্নত করা যায় তা নিয়ে কথা বলেন। তিনি আরও বলেন সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাবে যেমন পয়ঃবর্জ্য আমাদের জন্য মৃত্যুঝুকির কারণ তেমনি সঠিকভাবে এটিকে ব্যবস্থাপনা করতে পারলে সম্পদ হিসেবেও ব্যাবহার করা যায়। এছাড়াও তিনি তার বক্তৃতায় পানি ও নিরাপদ স্যানিটেশন নিশ্চত করার লক্ষে ওয়াটার এইডের কার্যক্রমের কথা তুলে ধরেন। ড. আবদুল্লাহ আল মুয়ীদ তার বক্তৃতায় কো-কম্পোস্ট প্ল্যান্টের কারিগরি বিষয়গুলো এবং এত অল্প জায়গায় কিভাবে প্রায় ৪০,০০০ মানুষের এই পৌরসভার সম্পূর্ণ পয়ঃ ও কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা যে সম্ভব সেটি তুলে ধরেন। তিনি আরও বলেন, এই কো-কম্পোস্ট প্ল্যান্টের চালু হবার আগে সখীপুর পৌরসভার সকল বর্জ্য নদী নালা খাল বিলের পানিতে মিশে যেত এবং তিন বছরে এই প্ল্যান্টের মাধ্যমে দূষণের হার ৪৬ শতাংশে নামিয়ে নিয়ে আসা হয়েছে। আগামী ২০২১ সাল নাগাদ সখীপুর পৌরসভার পয়ঃবর্জ্য ও কঠিনবর্জ্য থেকে দূষণের হার শূন্য শতাংশে নামিয়ে আনা সম্ভব হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন এবং একইসাথে সখীপুর হবে বাংলাদেশের মধ্যে প্রথম ১০০ ভাগ পয়ঃ ও কঠিন বর্জ্য দূষণমুক্ত পৌরসভা। প্রধান আতিথি ড. সুলতান আহমেদ তার বক্তৃতায় পরিবেশ রক্ষায় সঠিক বর্জ্য ব্যাবস্থাপনার প্রয়োজনীয়তা এবং সবার সচেতনাতার কথা তুলে ধরেন। প্রচলিত নিয়মের বাইরে গিয়ে বর্জ্য ব্যাবস্থাপনার এই ভিন্নধর্মী উদ্যোগ নেয়ার জন্য স্থানীয় মেয়রকে এবং আর্থিক ও কারিগরি সহযোগিতা দেবার জন্য ওয়াটার এইডকে ধন্যবাদ প্রদান করেন। তিনি তার পরিবেশ অধিদপ্তরের স্থানীয় প্রধানকে এই কো-কম্পোস্ট প্ল্যান্টকে মডেল ধরে আরও কিছু কো-কম্পোস্ট প্ল্যান্টের স্থাপন করার নির্দেশনা দেন। মনুষ্যবর্জ্যকে লাভজনক ভাবে অন্যান্য পচনশীল বর্জ্যরে সাথে ব্যাবহার করার এই প্রক্রিয়া অন্যান্য উপজেলায় স্থাপন করতে পারলে পরিবেশ রক্ষা পাবে এবং স্বাস্থ্যঝুকিও এড়ানো সম্ভব হবে বলে তিনি মতামত ব্যক্ত করেন। এছাড়াও তিনি বলেন এই প্রযুক্তি পরিবেশ অধিদপ্তরের মাধ্যমে সারাদেশে ছড়িয়ে দেয়ার ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে।
বক্তৃতাশেষে, সকলের উপস্থিতিতে, স্থানীয় উদ্যোত্তা প্রতিষ্ঠান ‘মেসার্স জোয়া এন্টারপ্রাইজ’ এর সাথে পরিচালনা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় এবং এর মাধ্যমে বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো কোন পয়ঃবর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য উদ্যোক্তা ভিত্তিক ব্যাবসায়িক মডেল চালু হলো।
পরে অতিথিরা প্ল্যান্টের পরিদর্শন কালে সম্পূর্ণ স্থানীয় উপকরণ ও মেশিনপত্র ব্যাবহার করে মনুষ্যবর্জ্য থেকে কম্পোস্ট সার উৎপাদনের এই পুরো প্রক্রিয়াটি সকলকে দেখানো হয়। পরিদর্শনের পর প্রধান অতিথি সহ পরিবেশ অধিদপ্তরের সকল কর্মকর্তারা সন্তোষ প্রকাশ করেন এবং মল ব্যাবস্থাপনার মত একটি জায়গা যে এরকম দুর্গন্ধমুক্ত হতে পারে তা নিয়েও সন্তোষ প্রকাশ করেন। একইসাথে অতিথিরা জিজ্ঞাসা করেন কিভাবে এতোটা দুর্গন্ধমুক্ত রাখা হয় এবং উৎপন্ন জৈব সারে ক্ষতিকর অণুজীবের অনুপস্থিতি নিশ্চিত করা হয়। ওয়াটার এইডের পক্ষ থেকে ড. আব্দুল্লাহ আল মুয়ীদ এর কারগিরি ব্যাখ্যা প্রদান করেন। পুরো কো-কম্পোস্ট প্ল্যান্টের প্রাকৃতিকভাবে এবং কোন প্রকার কেমিক্যাল ছাড়া পরিচালনার এই উদ্ভাবনী চিন্তার প্রশংসা করেন ড. সুলতান আহমেদ।