জাহিদ হাসান: আসমানীরে দেখতে যদি তোমরা সবে চাও,
রহিমদ্দির ছোট্ট বাড়ি রসুলপুরে যাও।
বাড়ি তো নয় পাখির বাসা ভেন্না পাতার ছানি,
একটুখানি বৃষ্টি হলেই গড়িয়ে পড়ে পানি। পল্লীকবি জসীমউদ্দীনের আসমানী কবিতার মতোই যেন টাঙ্গাইলের সখীপুর উপজেলার কালিয়া ইউনিয়নের কচুয়া গ্রামের মৃত. ওমর ফারুকের স্ত্রী ফজিলা বেগমের বাড়ি। ৬০ বছর বয়সী এই বৃদ্ধা, বিধবা হয়েছেন প্রায় এক যুগ আগে। ফজিলা বেগমের কষ্টের যেন শেষ নেই। থাকার কষ্ট, খাবারের কষ্ট, সব থেকে বড় কষ্ট, বৃষ্টি হলেই ঘরে পানি পড়ে। ঘুমাতে পারেন না বৃদ্ধা ফজিলা বেগম। মানুষ দিলে খাবার খেতে পারেন। তা না হলে, না খেয়ে থাকেন। এত কষ্টের পরেও স্বামীর রেখে যাওয়া ভিটায় জীর্ণশীর্ণ একমাত্র ঘরে বসবাস করছেন তিনি। এ যেন সত্যিকারের আসমানী।সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, অনেক পুরানো একটি ঘর, দরজার কাঠগুলো ঘুণ (কাঠখেকো পতঙ্গ) পোকায় খেয়ে ফেলেছে। টিনের চাল জং (মরিচা) ধরে জায়গায় জায়গায় ফুটো হয়ে গেছে। একটুখানি বৃষ্টি হলেই, গড়িয়ে পড়ে পানি। শোয়ার জায়গা থাকে না মাঝে মাঝে। বৃষ্টির পানি ঠেকাতে পলিথিন ও কাপড়ের ছাউনি দিয়েছে। টিনের চালে এত ফুটো হয়ে গেছে যে, সেগুলো বন্ধ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে গেছে বৃদ্ধা ফজিলা। চারপাশের বেড়া ও দরজা-জানালাগুলো ভাঙাচোরা। ঘরের খুঁটি গুলো এমনভাবে নড়বড় হয়ে আছে, মনে হচ্ছে একটু জোরে বাতাস হলেই উড়ে যাবে ফজিলা বেগমের শেষ স্বপ্ন।

একটা মাত্র থাকার ঘরে একপাশে ছেলে আর নাতনী নিয়ে থাকেন। আরেকপাশে কিছু বাড়তি আয়ের আশায় কয়েকটা ছাগল আর দেশী মুরগী পালন করেন ফজিলা। একই ঘরে থাকা-খাওয়া, ছাগল, মুরগি নিয়ে ঘরের ভেতর থাকার মতো পরিবেশ নেই। বাড়ির আঙ্গিনায় একটি সৌচাগার থাকলেও, সেটাও বেহাল দশা। ফজিলা বেগমের দাম্পত্য জীবনে তিন ছেলে জন্ম নিলেও, তিনটি ছেলেই বয়স বাড়ার সাথে সাথে প্রতিবন্ধী হয়ে যায়। বড় ও মেঝো ছেলে মারা যাওয়ার পর বর্তমানে ছোট ছেলে ও একমাত্র নাতনীকে নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন তিনি।
বৃদ্ধা ফজিলা বেগম জানান, আমার তিনটা ছেলেই প্রতিবন্ধী। বড় ছেলে ইফতিখার (৩০) চার বছর ও মেঝো ছেলে সোহেল (২৬) তিন বছর আগে মারা যায় স্ত্রী ও ছোট্ট একটি মেয়ে রেখে। ছোট ছেলে জুয়েল (২২) সেও প্রতিবন্ধী। সে হাঁটতে পারে না, ঘরের ভেতরেই তার সবকিছু। টাকার অভাবে সন্তানের চিকিৎসা করাতে পারিনি। আমার দুইটা ছেলে জীবিত থাকতে, কত কিছু খেতে চেয়েছে। কিন্তু আমি মা হয়ে তাদের পছন্দমতো কোন খাবার আমি খাওয়াতে পারিনি। এখন একটা ছেলে বেঁচে আছে। সে কত কিছু খেতে চায়, কিন্তু আমি কিনে দিতে পারি না। সেই সামর্থ্য আমার নাই।
তিনি কান্নাস্বরে বলেন, আমার একটা ঘর নাই। আমার ঘরটা ভাঙ্গা হওয়ায়, একটু বৃষ্টি হলেই ঘরের ভেতরে পানি পড়ে। আমার প্রতিবন্ধী ছেলে আর নাতনীটা নিয়ে খুব কষ্ট করে থাকি। আমি একটা ঘরের জন্য অনেকের কাছেই হাত বাড়াইছি। অনেকে স্বীকারও করেছে, আমাকে একটা ঘর করে দেবে। কিন্তু দেবো দেবো বলে, এখনোও আমাকে কেউ একটা ঘর করে দিলো না। আমার এই ভাঙ্গা ঘরে থাকাটা যে কত কষ্ট, বলে বুঝাতে পারবো না। আমার মা নাই, বাবা নাই বলতেই চোখ দিয়ে অঝোরে পানি ঝড়ছিল ফজিলার। নিজের আঁচল দিয়ে চোখ মুছে বললেন, আমি কার কাছে যামু? আমার তো মায়ের পেটের একটা ভাইও নাই, বোনও নাই। আমার তো যাওয়ার কোন জায়গা নাই। একটা থাকার ঘর পেলে, জীবনের শেষ বয়সে শান্তিতে মরতে পারতাম।
সংসার কিভাবে চলে এই প্রশ্নের জবাবে ফজিলা জানান, ছোট ছেলেটা প্রতিবন্ধী ভাতা পায়। আর আশপাশের মানুষ যে খাবার দেয়, তা দিয়ে দু’বেলা দু’মুঠো খেয়ে বেঁচে আছি। আর আমারে যদি কেউ একটা বিধবা ভাতার কার্ড করে দিত, তাহলে আমরা তিনজন আর একটু ভাল চলতে পারতাম। আমার মেঝো ছেলে মারা গেছে ৩ বছর হলো। তার রেখে যাওয়া একমাত্র মেয়ে, জান্নাতকে একটি মাদ্রাসায় ভর্তি করে দিয়েছি। তাকে কোনদিন কিছু খাওয়া বা কেনার টাকাও দিতে পারি না। তাকে ঠিকমতো কাপড় চোপড়ও দিতে পারি না। তার পড়াশুনার খরচটাও আমি চালাতে পারছি না। একেবারে অসহায় হয়ে পরেছি আমি।
ফজিলা বেগম আরও জানান, আমার মেঝো ছেলেটা মারা যাওয়ার আগে আমাকে বলে গেছে, “মা তোমার কাছে আমাদের বংশের বাতিটা দিয়ে গেলাম”। আমার খুব আশা নাতনীটাকে পড়াশুনা করাবো। কিন্তু কোথায় পাবো আমি এত টাকা? ছেলে মারা যাওয়ার পর ছেলের বউটা চলে গেলো। আমার নাতনীটা একেবারেই এতিম। আজ আমার সন্তান যদি সুস্থ থাকতো, তাহলে তো আমার এত কষ্ট হতো না। অনেকক্ষণ দীর্ঘশ্বাস নিয়ে ফজিলা বেগম বলেন, “আমি সন্তানহারা, আমার মতো সন্তানহারা আর যেন কেউ না হয়”।
স্থানীয়রা জানান, বৃদ্ধা ফজিলা বেগম সত্যিই একজন গরীব ও অসহায় মানুষ। সংসারে উপার্জনক্ষম কেউ না থাকায়, খেয়ে না খেয়ে তার জীবন চলছে। নতুন ঘর নির্মাণ করার সামর্থ্য তার নেই। তার একটি ছেলে জীবিত, সেও প্রতিবন্ধী। সরকারি কিংবা কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান তার পাশে দাঁড়ালে তিনি শেষ জীবনটা হয়তো ভালোভাবে কাটাতে পারবেন।
এদিকে গত (৩১ আগস্ট) রাতে তার বাড়ি থেকে মোবাইল ও চাল চুরির ঘটনা ঘটেছে। বৃদ্ধা ফজিলা বেগম জানান, মানুষের কাছে চেয়ে চেয়ে কিছু টাকা দিয়ে চাল কিনেছিলাম। গতরাতে আমার ভাঙ্গা ঘর থেকে চাল চুরি হয়েছে।
স্থানীয় ইউপি সদস্য মামুন সিকদার বলেন, ফজিলা বেগম খুবই অসহায়। ভাঙ্গা ঘরে বৃষ্টি-বাদল আর শীতের দিনে খুব কষ্ট হয় তার। মাথা গোজার ঠাঁই নেই। একটা ঘর হলে তিনি ভালোভাবে থাকতে পারবেন। তার ছেলে প্রতিবন্ধী ভাতা পান। ইউপি চেয়ারম্যানের সাথে কথা বলে খুব দ্রুত তাকে সাহায্য করা হবে।
উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা মনসুর আহমেদ জানান, ফজিলা বেগমের ব্যাপারে খোঁজ-খবর নেওয়া হচ্ছে। খুব শীঘ্রই তার বিধবা ভাতার ব্যবস্থা হবে। পাশাপাশি বৃদ্ধা ফজিলা বেগমের ঘর তৈরির জন্য অর্থ সহায়তার বিষয়ে আমিউপজেলা নির্বাহী অফিসার আব্দুল্লাহ আল রনী স্যারের সাথে কথা বলবো।