মো. আলীম মাহমুদ: আমি বাঙালি। আমি বাংলাদেশি বাঙালি। আমি Covidiot. করোনা ভাইরাস পৃথিবীকে বানিয়েছে একটি বৃহৎ হাসপাতাল। পৃথিবীকে হতবাক করে দিয়ে অদৃশ্য এই দানব ঘায়েল করেছে বিশ্বকে। সারা পৃথিবী করে দিয়েছে লকডাউন। আমেরিকা, ইতালী, স্পেন, কানাডা কিংবা লন্ডনের মতো উন্নত দেশগুলোর হিমাগারে লাশের স্তুপ, জায়গা হচ্ছেনা লাশ রাখার। প্রতিবেশি দেশগুলোতেও চব্বিশ ঘন্টা জ্বালিয়ে রাখতে হচ্ছে চিতা। করোনা সংক্রমণে মৃতের সংখ্যা পাঁচ লাখ ছুই ছুই। বাংলাদেশেও হাজার মানুষের মৃত্যুর কারন কোভিড-১৯। বিশ্বে আক্রান্তের সংখ্যা কোটি হতে বেশি দেরি নেই, বাংলাদেশও ছুতে যাচ্ছে লাখের মাইলফলক। মিডিয়াগুলো ব্যস্ত আক্রান্তের সংখ্যা আর মৃতের সংখ্যা নিয়ে। রাষ্ট্র ব্যস্ত লাশের সৎকার নিয়ে। আর আমরা মুখে একটা নামে মাত্র মাস্ক লাগিয়ে মহাবীর সেজে ঘুরে বেড়াচ্ছি যত্রতত্র। যাচ্ছি বাজার-ঘাটে, মার্কেটে। মিশে যাচ্ছি হাজারো ভিড়ে। নিজের সাবধানতার বালাই নাই, সচেতনতার লেশমাত্র নাই, অথচ! চায়ের দোকানে বসে হিসেব কষছি, কতো মরলো আর কতোইবা আক্রান্ত হলো। সামাজিক দূরত্ব কি, কিভাবে হয় তার খবর নাই, অন্যকে বলছি, ‘মরার ভয়ে ঘরে ঢুকছো, মরণ কি ঘর চিনে না।’

গ্লোবালাইজেশন বা বিশ্বায়ন সারা পৃথিবীকে একটি গ্লোবাল ভিলেজে পরিণত করেছিল, আর করোনা করেছে বিচ্ছিন্ন। রাষ্ট্র থেকে রাষ্ট্র বিচ্ছিন্নতাই করোনা থেকে সুস্থ্য থাকার পথ। সকল পথের যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়ে আত্ম-কেন্দ্রিক হয়েছে প্রতিটি রাষ্ট্র। নিজেদের সচেতন করেছে, সাবধান করেছে সব উন্নত এবং স্বল্পোন্নত রাষ্ট্রসমূহ। বিচ্ছিন্নতাকেই বেছে নিয়েছে, মেনেছে স্বাস্থ্যবিধি, মেনে চলেছে সামাজিক দূরত্ব। এর সুফলও পাচ্ছে তারা। ধীরে ধীরে সুস্থতার দিকে ধাবিত হচ্ছে সচেতন রাষ্ট্রগুলো। আর আমরা ব্যস্ত সেই খবর প্রচার নিয়ে। অমুক রাষ্ট্র করোনা মুক্ত হলো, তমুক রাষ্ট্র লকডাউন খুলে দিলো। আমেরিকায় মৃতের সংখ্যা কমতে শুরু করেছে, স্পেনে গত কয়েকদিনে করোনায় কেউ মারা যায়নি তাই মসজিদ খুলে দিলো, ইতালীতে কারোনার প্রকোপ কমেছে, নিউজিল্যান্ড করোনা মুক্ত এইসব খবর শুনতে, বলতে খুব ভালোবাসি আমরা। কারন আমরা বাঙালি। বাংলাদেশি বাঙালি। বাংলাদেশি বাঙালি বলার কারন হলো, অন্য দেশের বাঙালিদের থেকে দেশপ্রেমের দিক থেকে আমাদের বিস্তর ব্যবধান। অন্যের খবর প্রচার করতে ভালোবাসি আমরা। কিন্তু কিভাবে করোনা মুক্ত হলো, কিভাবে করোনার প্রকোপ কমলো সেটা জানতে বা মানতে নারাজ।
মনে মনে এই ভেবে সান্তনা নেই, এইতো কমতে শুরু করেছে। আর কটা দিন, তারপর আমরা মুক্ত। মানে, আমাদের জোড় করে নিয়ম মানতে বাধ্য করছে প্রশাসন বা সরকার, এতে আমাদের কোন লাভ নেই, শুধু শুধু জোড় করে আটকে রাখছে। সব লাভ সরকারের, আমাদের বাঁচানোর দায়িত্বও সরকারের। কিন্তু একবার এইটা ভাবি না, আমি আক্রান্ত হলে আমার পরিবার আক্রান্ত হবে, আমার স্বজনরা আক্রান্ত হবে। সরকারি হিসেবে হয়তো আক্রান্ত নয়তো মৃতের একটি সংখ্যা বাড়বে। কিন্তু আমার পরিবারের অবলম্বন কে? তাদের কি হবে? বিভিন্ন জায়গায় ঘুরেফিরি আর বলে বেড়াই সরকার এইটা করেনা ক্যান, ঐটা করেনা ক্যান? আরে বেটা, সরকার কি ঘরে ঘরে গিয়ে সুস্থ্যতার বড়ি দিয়ে আসতে পারবো? নিজে কি করছি সেইটা একবার ভাবা উচিত। নিয়ম মানছি কি না সেইটা দেখা উচিত, সামাজিক দূরত্ব নামক একটা জিনিস যে আছে সেইটা সম্পর্কে জানা উচিত এবং মানা উচিত। সেইটা না করে শুধু অন্যের দোষ দিয়ে বেড়াচ্ছি। প্রথমে দোষ দিলাম প্রবাসীদের, তারা কেন করোনা নিয়ে দেশে আসে। তারপর ঢাকাবাসীর। তারা কেন নিজের এলাকায় আসে? ঢাকায় থাকতে পারেনা। এলাকায় করোনা নিয়ে আসে। গণপরিবহন, গার্মেন্টস, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সবার দোষ বলে বেড়ালাম। এরপর….. যখন পাশের গ্রামের কেউ আক্রান্ত হলো তখন না হয় ঔ গ্রামের দোষ, যখন পাশের বাড়ির কেউ আক্রান্ত হবে? আপনার বাড়ির কেউ আক্রান্ত হবে, আমি আক্রান্ত হবো, আপনি আক্রান্ত হবেন, তখন? কার দোষ দিবো? কার দোষ দিবেন?
বাংলাদেশের প্রায় সকল জাতীয় দৈনিকের খবর, স্বাস্থ্যসেবা সামগ্রী ক্রয় বাবদ বিশাল এক বাজেট দিয়েছেন স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্টরা। যার প্রকৃত দামের ধারের কাছেও নেই। যেন করোনার সুযোগে বিশাল এক সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে তাদের। কমিশন ভাগ ভাটোয়ারা নিয়ে ব্যস্ত। ওয়েব সাইট ডেভেলপ নিয়ে ব্যস্ত, সফটওয়্যার কেনা নিয়ে ব্যস্ত। যেখানে করোনা পরীক্ষার কীট দেশীয় উদ্ভাবন করাটা নিলে খরচ হয় তিনশ’-চারশ’ টাকা সেখানে বিদেশ থেকে আমদানী করে; যার খরচ পড়ে তিন থেকে চার হাজার টাকা। হ্যান্ড গ্লাবস, মাস্ক, গগলসেরও একই অবস্থা। করোনাও পরিণত হয়েছে ব্যবসায়। মানুষের জীবন মৃত্যুর ব্যবসা। চলছে রমরমা করোনা নেগেটিভ সার্টিফিকেট বিক্রির ব্যবসাও। এ যেন কারও পৌষ মাস কারও সর্বনাশ। কেউ করোনা পরীক্ষার জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছে আবার কেউ ভিন্ন পথে পরীক্ষা করিয়ে অন্যদের চাইতে দ্রুত রিপোর্ট হাতে পাচ্ছেন। অন্যদিকে প্রশাসনের একেক সময় একেক সিদ্ধান্তে জাতি দ্বিধা দ্বন্ধে। আবার গার্মন্টস মালিকরা নিচ্ছে অন্যরকম সিদ্ধান্ত। এতোদিন শ্রমিকের রক্ত চুষে এখন আঠি ফেলে দিতে চাইছেন। এদের আপনি কি বলবেন? মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের মানুষের ভোগান্তির কথা চিন্তা করে প্রণোদনা ঘোষণা করলেন। প্রণোদনা দিলেন। সত্যিই একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ। সাধারণ জনগণ পেলো দুই হাজার পাঁচ শ’ করে আর মোবাইল ব্যাংকিং সেবা দেয়ার নাম করে কামিয়ে নিলো কোটি কোটি কোটি টাকা। যাঁরা স্বার্থের কথা চিন্তা না করে সেবা দিতে চাইছে তাঁদের আমরা আটকে দিচ্ছি এয়ারপোর্টে, রাখছি হোম কোয়ারান্টিনে অথবা বানিয়ে দিচ্ছি খুনির বংশধর কিংবা আরও হিংসাত্মক হতেও বাঁধছে না। কেন? আমাদের আতে ঘাঁ লাগে বলে নাকি কমিশন পাইনা বলে? আমরা বাঙালি, আমরা হেসে খেলে করোনায় সংক্রমিত হতে চাই, মরতে চাই, এই দেশে নি:স্বার্থ ভাবে কাজ করতে চাওয়াটা অপরাধ। আমরা উদ্ভাবিত কীট অনুমোদনের নাম করে ঝুলিয়ে রাখি। আমরা চিকিৎসাসেবা দেয়া ডাক্তারদের রাখি অরক্ষিত। মুখে বলি ‘জয় রাম, জয় রাম অন্তরে হরি বল, বল হরি।’ নিজেদের উদ্ভাবন পাঠাই বিদেশে আর বিদেশ থেকে আনছি আমদানী করে, কি লাভ আমার বুঝে আসেনা। হয়তো পাঠক বুঝবে।
অক্সফোর্ড ডিকশনারীতে নতুন এই শব্দটি যুক্ত হয়েছে Covidiot. যার অর্থ হচ্ছে, ‘A person who annoys other people by refusing to obey the social distancing rules designed to prevent the spread of CIVID-19.’ অর্থাৎ করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়া প্রতিরোধের জন্য তৈরি সামাজিক দূরত্ব ও নিয়ম কানুন মানতে অস্বীকার করে এবং অন্য ব্যক্তিদের অনুৎসাহিত করে এমন ব্যক্তি। এখন আপনি কাকে বলবেন Covidiot? যে মহাবীর সেজে পাতলা কাপড়ের মাস্ক পরে চায়ের দোকানে বসে আক্রান্ত-মৃতের হিসেব করে তাকে? নিজে সতর্কতা, সাবধানতা না মেনে অন্যকে উসকানী দেয় তাকে? নাকি যে করোনাকে ব্যবসা হিসেবে নিয়েছে তাকে? যে কমিশন খাওয়ার ধান্দায় জীবন মৃত্যুর খেলায় নেমেছে তাকে? যে করোনা নেগেটিভ সার্টিফিকেট বিক্রি করছে তাকে? নিজের দোষ না বুঝে যে অন্যের দোষ ধরে বেড়াচ্ছে তাকে? নাকি যাঁরা নি:স্বার্থভাবে দেশকে ভালোবাসতে চায় তাদের? নি:স্বার্থভাবে দেশের মানুষের সেবা করতে চায় তাদের? কাকে বলবেন Covidiot? অক্সফোর্ড ডিকশনারী বাংলাদেশকে মাথায় রেখে শব্দের অর্থটা করেনি। তাহলে হয়তো করোনা ব্যবসায়ী, করোনা নেগেটিভ সার্টিফিকেট ব্যবসায়ী, মোবাইল ব্যাংকিং কমিশনধারী, আমদানীকারক কমিশনধারীও অন্তর্ভূক্ত হতো। আরও অন্তর্ভূক্ত হতো সেইসব ব্যক্তিরা, যারা নি:স্বার্থভাবে দেশকে ভালোবাসতে চায়, দেশকে সেবা দিতে চায়। এরাই আসলে সত্যিকারের Covidiot. কারন এরা সবাই বাঙালি, বাংলাদেশি বাঙালি। এদের নি:স্বার্থ ভাবে ভালোবাসা উচিৎ নয়। এদের নি:স্বার্থ ভাবে ভালোবেসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মতো মহাপুরুষদেরও প্রাণ দিতে হয়েছে।
-লেখক: প্রভাষক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, সরকারি মুজিব কলেজ, সখীপুর, টাঙ্গাইল।
E-mail: alim746khz@gmail.com
–এসবি/সানি