আঃ রাজ্জাক বি.এ.বি.এড:

টাঙ্গাইল জেলার অন্তর্গত তৎকালীন কালিহাতী থানার আওতাধীন এবং বর্তমান সখীপুর উপজেলার ২নং বহেড়াতৈল ইউনিয়নস্থ একটি অজপাড়াগাঁ ‘কালিয়ান’। লাল মাটি অধ্যুষিত পাহাড়ের পাদদেশে বংশাই নদীর পূর্ব পাড়ে গ্রামটির অবস্থান। গ্রামের শান্ত-নিরিহ মানুষ গুলো রূপকথার কল্পকাহিনী শুনেছে। রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয় তা-ও হয়তো শুনেছে লোক মুখে। কিন্তু অত্যাধুনিক মারণাস্ত্রে সুসজ্জিত মেশিন গান, মর্টার, রাইফেল, বেয়োনেটের যুদ্ধ দেখা তো দূরের কথা, কানেও শুনেনি কখনো। অথচ এই অজপাড়াগাঁয়ের মানুষই একদিন স্বচক্ষে দেখলো সেই অনাকাঙ্খিত সম্মুখ যুদ্ধ।
১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চের ‘কালো রাতে’ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হয় করাচীতে। অপরদিকে টিক্কা খানের ঘোষণা ছিল- ‘বাংলার মাটি চাই, মানুষ চাই না।’ যার প্রেক্ষিতে পাক-হানাদার বাহিনী হিংস্র নেকড়ে বাঘের মতো ঝাপিয়ে পড়ে নিরপরাধ -নিরীহ বাঙালীর উপর। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষন অনুযায়ী বাঙালী জাতি ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তুলে। ফলে শুরু হয় অসম রক্ত ক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ। ক্রমাগত এই যুদ্ধ গ্রামে-গঞ্জেও ছড়িয়ে পড়ে। সেই ধারাবাহিকতায় কালিয়ান গ্রামেও সংঘটিত হয় মুক্তিযুদ্ধ তথা বর্বরোচিত নৃশংস হত্যা ও অমানুষিক নির্যাতন।
সে-দিন ছিল ১ জুলাই ‘৭১ রোজ বৃহস্পতিবার। সূর্য্যি মামা প্রতি দিনের মতো পূর্বাকাশে উদিত হয়ে আলোর বিকিরণ ঘটাচ্ছে। গ্রামের সহজ-সরল, নিরীহ মানুষগুলো তাদের প্রাত্যহিক কাজে ব্যতি-ব্যস্ত। এহেন শান্ত, স্নিগ্ধ, সুষমা ভরা সুন্দর পরিবেশে অকস্মাৎ পশ্চিমাকাশে বেজে উঠে যুদ্ধের দামামা।
৩০শে জুন ‘৭১ একটি সুসজ্জিত পাকিস্তানী বাহিনী কাউলজানী হাইস্কুল মাঠে ছাউনি ফেলে অবস্থান নেয়। পরের দিন সকালে সাতটি বড়ো-বড়ো নৌকা যোগে রওনা হয় মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটি বহেড়াতৈল বাজারের দিকে। ‘কাদেরীয়া বাহিনী’র অন্যতম কমান্ডার খন্দকার আবু মোহাম্মদ মুসার নেতৃত্বে কতিপয় মুক্তিবাহিনী দিগলাচালা জিগির ফকিরের টিলায় বাংকার তৈরী করে পজিশন নিয়ে ছিলেন। বংশাই নদী দিয়ে খান সেনাদের নৌকার বহর ক্রমশ এগিয়ে চলতে থাকে উজান বেয়ে। নয়াপাড়া আমীর সরকারের বাড়ীর সন্নিকটবর্তী হওয়া মাত্র দিগলাচালা হতে মুক্তিবাহিনীদের রাইফেল গর্জে উঠে। উভয় পক্ষে শুরু হয় তুমুল যুদ্ধ। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস! পাকসেনাদের অত্যাধুনিক মারণাস্ত্রের তুলনায় মুক্তিবাহিনীদের অস্ত্র -শস্ত্র, গোলাবারুদ ছিল খুবই নগণ্য। তাই গোলাবারুদের অপ্রতুলতাহেতু শেষ পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধা দল পিছু হটতে বাধ্য হন। আত্মরক্ষার্থে তাঁরা নিরাপদ অবস্থানে চলে যান। ফলে খানসেনা, রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনী বাঁধাহীন ভাবে গ্রামের আনাচে-কানাচে ঢুকে পড়ে এবং নির্বিচারে চালাতে থাকে অমানুষিক নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞ। কুখ্যাত বাহিনীর নিষ্ঠুর-নির্মম, ঘৃণ্য-বর্বোরোচিত হত্যা যজ্ঞের শিকার হন নিম্নোক্ত ১৮ জন গ্রামবাসী।
০১. মোঃ জাবেদ আলী মিয়া (জোতদার)।
০২. মোঃ আজিজুল হক (কৃষক)।
০৩. কাজী দুলাল হোসেন (ছাত্র)।
০৪. মোহাম্মদ ছেন্টু মিয়া ( ছাত্র)।
০৫. মোঃ আব্দুছ ছালাম মিয়া (কৃষক)।
০৬. মোঃ আঃ হাই শিকদার (গ্রাম্য মাতব্বর)।.
০৭. মোঃ লাল মাহমুদ মিয়া (কৃষক)।
০৮. মোঃ ছানোয়ার হোসেন (কৃষক)।
০৯. মোহাম্মদ বাচ্ছু মিয়া (কৃষক)।
১০. মোঃ ইয়াছিন আলী (ছাত্র)।
১১. মোঃ বিলাত আলী মিয়া (কৃষক)।
১২. মোঃ আবদুল খালেক (কৃষক)।
১৩. মুন্সী রমিজ উদ্দীন মিয়া (দুয়ানী পাড় জামে মসজিদের ইমাম)।
১৪. মোঃ জোনাব আলী সরকার ( গ্রাম্য মাতব্বর)।
১৫. মোঃ হাবিবুর রহমান মুন্সী (কৃষক)।
১৬. মোহাম্মদ আরজু মিয়া (কৃষক)।
১৭. মোঃ ইসমাইল হোসেন (কৃষক)।
১৮. শ্রী হ্নদয় চন্দ্র মন্ডল (গ্রাম্য চৌকিদার)।
স্মর্তব্য: ১৮ জন শহীদের মধ্যে ১৬ জনের ক্ষত-বিক্ষত লাশের সৎকার করা হয় যথারীতি। কিন্তু আমার সহোদর বড়ো ভাই বিলাত আলী মিয়ার লাশ পাওয়া যায়নি। বংশাই নদীর জলে ভেসে গিয়েছিল। আমার চাচাতো ভাই বাচ্ছু মিয়ার লাশ দু’দিন পর ঝোপের ভেতর থেকে উদ্ধার করা হলেও উজান থেকে আগত পাকবাহিনীর ভয়ে দাফন করা সম্ভব হয়নি।
নৃশংস হত্যাযজ্ঞ চলাকালে খান সেনা ও তাদের দোসরদের গুলি ও বেয়োনেটের আঘাতে গুরুতর আহত হন (১) মোঃ হারুন মিয়া (২) মোঃ লেবু মিয়া (৩) মোঃ জয়নাল আবেদীন (নয়া মিয়া) ও (৪) ইনজিরন নেছা বিবিসহ আরো কয়েক জন। পাকিস্তান আর্মির অমানুষিক নির্যাতনের শিকার হন অত্র গ্রামের নিম্নোক্ত ৭ জন বিশিষ্ট ব্যক্তি।
০১. আলহাজ্ব খারশেদ আলম (খসরু)।
০২. মোঃ ইয়াকুব আলী মিয়া।
০৩. মোঃ আবদুল জলিল মিয়া।
০৪. মোহাম্মদ ঘটু মিয়া।
০৫. মোঃ হায়দার আলী ।
০৬. মোঃ ছোহরাব আলী (ফটু)।
০৭. মোহাম্মদ চানু মিয়া।
শুধু তাই নয়, রাজাকার, আলবদর বাহিনীর প্রজ্জ্বলিত অগ্নির লেলিহান শিখায় সম্পূর্ণ রূপে ভস্মীভূত হয়ে যায় কালিয়ান পশ্চিম পাড়া, দুয়ানী পাড়া ও নয়া পাড়ার শতাধিক পরিবারের বাসত-ভিটা তথা ঘর-বাড়ি, খাট-পালঙ্ক, বিছানা-পত্র, বাসনকোসন, তৈজসপত্র ইত্যাদি। স্বজন হারা, গৃহ হারা, সর্বস্ব হারা পরিবারের মধ্যে নেমে আসে অমানিশার ঘোর অন্ধকার। পুত্র হারা পিতা -মাতা, পিতা হারা সন্তান, ভাই হারানো ভাই-বোন এবং সদ্য স্বামী হারা বিধবা দয়িতার বুক ফাটা আর্তচিৎকারে আকাশ-বাতাস হয় প্রকম্পিত। ইসরাফিলের প্রলয় শিঙা বুঝি বেজে উঠে কালিয়ানের বুকে। এমন হ্নদয়বিদারক লোমহর্ষক দৃশ্য; যা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না।
আজ ১লা জুলাই ২০২০ খ্রিস্টাব্দ। স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে ইতোমধ্যে অতিক্রান্ত হয়ে গেছে উনপঞ্চাশটি বছর। কিন্তু কালিয়ান গ্রামের সে-ই ১৮ জন শহীদের রক্তের দাগ এখনো শুকায়নি। খোলা আকাশের নীচে রাত কাটানোর স্মৃতি ¤øান হয়ে গেলেও গ্রামবাসী আজও ভুলতে পারেনি সেদিনের সে-ই ‘রক্তে ভেজা দিন’টির কথা। আজো ছেলে হারানো মা নির্জনে-নিভৃতে চোখের জলে বুক ভাসিয়ে কাঁদে।
কালিয়ানের কৃতি সন্তান; যাঁদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ তাঁদের প্রতি লাখো সালাম, ভক্তি, অর্ঘ্য ও শ্রদ্ধা। আহত ও নির্যাতিতদের মধ্যে অনেকেই আজ পরপারে। যাঁরা জীবিত আছেন; তাঁরাও এখন রোগ-ব্যাধি তথা বার্ধক্য জনিত কারণে অকেজো প্রায়। মৃত্যুর আগে তাঁদের সাধ ছিল একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি লাভের। কিন্তু তা হয়তো সুদূর পরাহত। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, শত্রু সেনা যাঁদেরকে মুক্তিবাহিনী ভেবে হত্যা, আহত ও নির্যাতন করলো, তাঁরা স্বাধীন বাংলাদেশে মুক্তিযোদ্ধার মর্যাদা বা ‘সনদ’ পেলোনা। এরচেয়ে দুঃখজনক আর কি হতে পারে? তবু জীবন সায়াহ্নে দাঁড়িয়ে আমি শেষ বারের তো কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি, যদি সম্ভব হয়……………………..।
ইতোমধ্যে সখীপুর উপজেলার তৎকালীন নির্বাহী কর্মকর্তা স্বর্গীয় বিমল চন্দ্র দাস শহীদদের নামাঙ্কিত একটি ‘স্মৃতি ফলক’ নির্মাণ করে দেন। সাম্প্রতিককালে ‘সখীপুর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ’ এর উদ্যোগে ‘বধ্যভূমি’ প্রকল্পের আওতায় কালিয়ান উচ্চবিদ্যালয়ের সন্নিকটে শহীদদের স্মরণে একটি ‘বধ্যভূমি স্মৃতি স্তম্ভ’ নির্মিত হয়েছে। এজন্য আমি গ্রামবাসীর পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্ট সকলকে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
পরিশেষে, আমি আমার প্রাণপ্রিয় জন্মভূমি কালিয়ানের বর্তমান যুবসমাজ ও পরবর্তী প্রজন্মের প্রতি আকুল আহবান জানাচ্ছি; মনে রেখো, হতাহত ও নির্যাতিত ব্যক্তিগণ এই গ্রামেরই গর্বিত সূর্য সন্তান। তাঁরা আমাদের গর্ব, আমাদের অহংকার। শহীদের মর্যাদাবা মুক্তিযোদ্ধা সনদ কোনটাই তাঁদের ভাগ্যে না জুটলেও তাঁরা অলিখিত ‘শহীদ’ এবং ‘মুক্তিযোদ্ধা’। তাই প্রতি বছর ‘পহেলা জুলাই দিবস’ ঘটা করে উৎযাপন করতঃ তাঁদের বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা ও সম্মান প্রদর্শন করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। কারণ, ‘আমাদের স্বজনের রক্তে রাঙানো পহেলা জুলাই; আমরা কি তাঁদের ভুলে যেতে পারি?’
-লেখক: সাবেক সিনিয়র শিক্ষক, সখীপুর পিএম পাইলট মডেল গভঃ স্কুল এন্ড কলেজ, সখীপুর, টাঙ্গাইল।
–এসবি/সানি