
সম্পূর্ণ অপরাজিত থেকে সাফ-ফুটবলে বিজয়ী হয়েছে বাংলার অনূর্ধ্ব পনেরো-এর নারী ফুটবলাররা— বাংলাদেশের প্রতিটি আনাচে-কানাচে এখন এই সময়ে এটিই সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা। বিশ্ব দরবারে তারা উড়িয়েছে লাল সবুজের পতাকা। অপরাজেয় এই ফুটবল নারীদলের বিক্রমে বাংলার মর্যাদা আজ উন্নীত-উড্ডীন। উল্লিখিত বাংলার অমিত নারী ফুটবলারদেরই যেন প্রতিচ্ছায়া দেখতে পেলাম সখীপুর উপজেলার ছিলিমপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের খুদে নারী ফুটবল দলের মধ্যে। তারা সখীপুর উপজেলার মধ্যে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে কদিন আগেই। এরপর তারা টাঙ্গাইল জেলায় অন্যদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে গিয়েছিল ২৪শে সেপ্টেম্বর শনিবার— সেখানে অবশ্য তারা এক শূন্য গোলে হেরেছে। কিন্তু এ কথা ধৃষ্টতা নিয়েই বলতে পারা যায় যে— জেতা বা হারা সেটা গৌণ; মুখ্য হচ্ছে প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের সক্ষমতা প্রমাণ করা— সখীপুরের এই খুদে নারী ফুটবল দলের সদস্যরা সে সক্ষমতা প্রমাণ করেছে।

বর্তমান সময়ে নারীদের স্বাচ্ছ্যন্দময় পরিধেয় পোশাক নিয়ে যেখানে কূট-বিতর্কে সয়লাব সারা দেশ; নারীর শিক্ষা ও সংস্কৃতিচর্চা নিয়ে মোল্লা-পুরুতদের দৌরাত্ম্যের যেখানে শেষ নেই; নারীর সহজ, সাবলীল ও সহজাত অধিকার প্রতিষ্ঠায় যেখানে এখনো সমাজের প্রগতিশীল অংশকে সোচ্চার থেকে গলদগর্ম হতে হয়— সেখানে নারীদের ফুটবল মাঠে প্রতিযোগিতামূলক অংশগ্রহণের মধ্যদিয়ে নিজেদের মনুষ্যত্বের মর্যাদায় সমুন্নতিদান করবার চেষ্টা, এটা কম কথা নয়— হোক সে নারী বয়সে যতই ক্ষুদ্র। আজ যে ক্ষুদ্র, আগামী দিনেই সেই হয়ে ওঠবে বিশাল-বিরাট-বৃহৎ— এতে কোনোই সন্দেহ থাকার কথা নয়। কে জানে ছিলিমপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এই খুদে নারী ফুটবল দলের ভেতরেই লুকিয়ে আছে হয়তো সদ্য উপমহাদেশ জয় করা কৃষ্ণা রানী, রুপনা চাকমা, আঁখি খাতুন, মাসুরা পারভীন, শিউলি আজিম, শামসুন্নাহার, মনিকা চাকমা, মারিয়া মান্দা, সানজিদা আক্তার, সাবিনা খাতুন, সিরাত জাহানরা।
চর্যাগবেষক, জাতীয় সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক প্রিন্সিপাল আলীম মাহমুদ এবং আমি সখীপুরের এই খুদে নারী ফুটবল দলের প্রতি নিষ্কলুষ অভিনন্দন ও কৃতজ্ঞতা জানাতে পেরে আনন্দিত ও উচ্ছ্বসিত— তাদের হারা বা জেতার জন্য নয়, প্রতিযোগিতায় তাদের তুমুল অংশগ্রহণের জন্য।
নারী ফুটবল খেলা— সংস্কৃতির এই বিশেষ শাখায় অংশগ্রহণের মধ্যদিয়ে এই ক্ষুদ্ররাই একসময় বাংলাদেশের সীমা অতিক্রম করে বিশ্বসভায় নিজেদের স্থান করে নেবে স্ব-স্ব ক্ষেত্রে। জানি, তাদের এই ফুটবল খেলায় অংশগ্রহণ শুধু ফুটবল খেলার মাঠেই সীমাবদ্ধ থাকবে না, তা জীবন প্রগতির সর্বক্ষেত্রে বিস্তৃত পরিসরে স্থান করে নেবে— এর ফলেই এগিয়ে যাবে শিক্ষা, সমাজ, রাষ্ট্র, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও জাতীয় সংস্কৃতি। এটা নিরঙ্কুশভাবে স্বীকার্য যে, বঙ্গবন্ধু অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বাংলাদেশকে যেভাবে দেখতে চেয়েছিলেন, অতি সম্প্রতি সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে নারী ফুটবল দলটি যেন তারই প্রতিনিধিত্ব করেছে। নিশ্চিতভাবেই এই দলটি বাংলাদেশের মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের প্রতিনিধিত্ব করেছে। বাংলাদেশ যে অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও জাতীয় সংস্কৃতির বহুত্বকেই লালন করে চলেছে, এই নারী ফুটবল দলটি যেন তারই এক প্রামাণ্য প্রতিচ্ছবি।
গণমাধ্যম থেকে জেনেছি, আমাদের সমাজে-রাষ্ট্রে একজন নারী ফুটবলারকে ইতঃপূর্বে হাফপ্যান্ট পড়ার জন্য বাসের মধ্যে দারুণভাবে হেনস্থা হতে হয়েছিল, এক নারী ফুটবলারের পিতাকে নির্মমভাবে পেটানো হয়েছিল তার কন্যার হাফপ্যান্ট পড়ার জন্য। এটা মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে যে, সাব ফুটবল গেমসে নারীদের অংশগ্রহণ ও বিজয়ী হওয়া এবং আজ এই সখঘপুরের খুদে নারী ফুটবল দলের টাঙ্গাইলে গিয়ে তীব্র প্রতিযোগিতাপূর্ণ ফুটবল ক্রীড়ায় অংশগ্রহণ করা— এই সবকিছু সেই সেদিনের অন্যায় ও নারীদের ছোটো-নীচু করে দেখার তাবৎ কুসংস্কারের বিরুদ্ধে দারুণ প্রতিবাদ হয়ে এক উন্নত দৃষ্টান্ত প্রতিষ্ঠা করবে।
বিপুল উৎসাহ ও তুমুল উদ্যোমে এগিয়ে যাও সখীপুরের অপ্রতিরোধ্য দামাল কন্যাসহ বাংলার খুদে থেকে পরিণত সকল বয়েসী নারীকুল— যারা অপসংস্কৃতির শৃঙ্খলভাঙায় থাকবে সদা প্রস্তুত। মনে রেখো— সমাজ, রাষ্ট্র, রাজনীতি ও জাতীয় সংস্কৃতি কতটুকু উন্নত হয়েছে বা হচ্ছে তা বোঝা যাবে সমাজে তোমরা কতটা এগিয়ে যাচ্ছো ও এগিয়ে থাকছো তার ওপর…
–লেখক: নাট্যজন আলী হাসান।
–এসবি/সানি